স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ: বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ওপর এক অন্ধকার যুগের সূচনা ।
২০২৫ সালের ১০ মে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের সবচেয়ে পুরোনো এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তটি শুধু একটি রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা নয়—এটি দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের ওপর এক গভীর আঘাত এবং জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো এক সংকটপূর্ণ পদক্ষেপ।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞা একটি চরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা, যা শুধুমাত্র তখনই গ্রহণযোগ্য যখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে এবং তা যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। অথচ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই নিষেধাজ্ঞা কোনও স্বচ্ছ বিচারিক তদন্ত বা নিরপেক্ষ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয়, বরং একটি অনির্বাচিত ও স্বঘোষিত অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়েছে। ফলে এ পদক্ষেপের বৈধতা ও নৈতিকতা দুই-ই প্রশ্নবিদ্ধ।
আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতার পর দলটি সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নির্মাণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করছে, এই নিষেধাজ্ঞা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে বলবৎ থাকবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এটি মূলত সরকারের অবৈধ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে একটি কৌশল মাত্র।
সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণভাবে সংগঠন করার অধিকার বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি মৌলিক অধিকার। কোনও রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার আগে স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়া, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তদুপরি, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী—বিশেষ করে International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR)-এর ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে—প্রতিটি নাগরিকের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার সুরক্ষিত এবং এটি শুধু অপরিহার্যতা, অনুপাত এবং আইনি বৈধতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই সীমিত করা যেতে পারে।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের পরপরই ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। ভারত সরকার বাংলাদেশে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আহ্বান জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট সতর্ক করে যে, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে গেলে তা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একাধিক সদস্য ও বিশেষজ্ঞরা এই পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র সূচকের পরিপন্থী এবং বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতার উৎস বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক সাম্যবোধের ওপর একটি বড় আঘাত হিসেবে দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল—যার শিকড় গ্রামীণ সমাজ থেকে শুরু করে নগরবাসীর মননেও প্রোথিত—তাকে নিষিদ্ধ করা মানে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতামত, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণকে উপেক্ষা করা। এর ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে তা শুধু একটি রাজনৈতিক দলকে নয়, বরং বাংলাদেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং জনগণের স্বকীয়তা ও রাজনৈতিক অধিকারকে নিষিদ্ধ করারই নামান্তর। একটি অকার্যকর, অনির্বাচিত সরকারের হাতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে দেশের দীর্ঘমেয়াদী বৈধতা সংকট, সামাজিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ, গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানো এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। গণতন্ত্র, সংবিধান ও জাতীয় ঐক্যের পক্ষে, ইতিহাসের পক্ষ হয়ে দাঁড়াবার এখনই সময়।
লেখকঃ ড. মোহাম্মদ শাহ্ নেওয়াজ
পররাষ্ট্রনীতি গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক,
আইএমও (IMO)-তে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের সাবেক পলিসি উপদেষ্টা।