সারওয়ার-ই আলম,
অতিথি প্রতিবেদক, জগন্নাথপুর টাইমস, লন্ডন :
গানে গানে, সুরে সুরে গত ২৩শে নভেম্বরের শীতার্ত সন্ধ্যাটিকে দারুণ উপভোগ্য করে তুলেছিলেন স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী সঞ্জয় দে। পূর্ব লন্ডনের আয়রা সেন্টারি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ অভ্যাগতদের উপস্থিতিতে গমগম করছিল বিভিন্ন বয়সের সঙ্গীত পিপাসু দর্শক-শ্রোতা। মেঘলা দিনের বৃষ্টিস্নাত বৈরী আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে অনেকেই এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে। কেউ একা, কারো সঙ্গে পরিবারের সদস্যবৃন্দ। সকলের অধীর অপেক্ষা মাইক্রোফোন থেকে কাঙ্খিত শিল্পীর সুর ভেসে আসার।
টেলিভিশন উপস্থাপিকা ও আবৃত্তিকার ঊর্মি মাযহার আমন্ত্রণ জানালেন শিল্পীকে। চারদিকে করতালি। মাইক্রোফোনের সামনে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে শুরু হলো শিল্পী সঞ্জয় দে’র সঙ্গীত পরিবেশন। সৃষ্টি হলো কথা ও সুরের এক অপূর্ব মোহবিষ্টতা; জনপ্রিয় বাংলা গানের মায়া এবং গজলের মাধুর্যমিশ্রিত আবেশ। আর সেই আবেশে নিজেদেরকে আপ্লুত করলেন দর্শক-শ্রোতা।
সঞ্জয় একজন বহুমাত্রিক সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর কণ্ঠ ভরাট, উচ্চারণ পরিশীলিত আর সঙ্গীতের পরিবেশন অর্থাৎ গায়কীটা একেবারে হৃদয় থেকে উৎসারিত।
শুরুটা করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। ‘ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে’— বহুল জনপ্রিয় এই রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে রবিবাসরীয় সঙ্গীতায়োজনের সূচনা। যন্ত্র সঙ্গত করছিলেন স্যান্ডিমান, তন্ময় , ইন্তেজার ও ঘনশ্যাম ।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর তিনি পরিবেশন করেন মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কয়েকটি কালজয়ী বাংলা গান এবং জগজিৎ সিং ও পঙ্কজ উদাসের কয়েকটি বিখ্যাত গজল। সোনালি দিনের বাংলা গানগুলোর মধ্যে ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’— দর্শকদেরকে আনন্দে ভাসায়। তাঁরা মুহুর্মুহু করতালিতে শিল্পীকে অভিনন্দিত করেন।
সোনালি দিনের বাংলা গানের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের দর্শকদের পছন্দ মাথায় রেখে গাইতে ভুললেন না ভাওয়াইয়া, বাউল ও গজল। বাংলা লোকগীতির কিংবদন্তী শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের ” ও কি একবার আসিয়া, সোনার চাঁদ মোর যাও দেখিয়া রে”— গানটি হলভর্তি দর্শদকের মনে এতটাই মোহন-মুগ্ধতা ছড়ায় যে দর্শকদের অনেকেই হেলেদুলে, শিল্পীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে উপভোগ করছিলেন বাংলার ঘরে ঘরে আবহমান এই ভাওয়াইয়া গানের সুষমা। এ পর্যায়ে সঞ্জয় একটি চমক উপহার দেন। আব্বাস উদ্দিনের গানের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে পরিবেশন করেন আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পী রিচার্ড মার্ক্সের জনপ্রিয় গান— ওশেন্স অ্যাপার্ট ডে আফটার ডে, এন্ড আই স্লোলি গো ইনসেইন, আই হিয়ার ইউর ভয়েস অন দ্য লাইন, বাট ইট ডাজেন্ট স্টপ দ্য পেইন’। তাঁর এ নিরীক্ষাধর্মী প্রয়াস দর্শকদের প্রশংসা লাভ করে।
দর্শকদের কারো কারো অনুরোধ ছিল শাহ আবদুল করিমের গানের জন্য। শিল্পী নিরাশ করলেন না তাঁদেরকেও । পরম দরদ দিয়ে গাইলেন ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি’। গানটি দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়। তাঁরা আবেগাপ্লুত হন। শিল্পীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জানান দেন তাদের ভাললাগার ও ভালবাসার কথা। সমবেত দর্শকদের এই আবেগাপ্লুত হওয়া প্রমাণ করে প্রয়াণের দেড় দশক পরে শুধুই দেশেই নয় বিলেতের বাংলাভাষীদের কাছেও শাহ আবদুল করিম সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।
সেদিন সন্ধ্যায় গানের পাশাপাশি সঙ্গীতায়োজনটি আরও উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল ঊর্মি মাযহারের প্রাঞ্জল কণ্ঠে উপস্থাপিত সাবলীল আবৃত্তি ও কাব্যিক সংলাপে। গানের ফাঁকে ফাঁকে প্রেম-প্রলুব্ধ কবিতার অংশ বিশেষ আবৃত্তি করে তিনি আকৃষ্ট করছিলেন কবিতাপ্রেমী দর্শকদেরকে। আবার কখনও কোনও কোনও গানের শুরুতে তুলে ধরছিলেন গানটি রচনার প্রেক্ষাপট, যা শিল্পীর পাশাপাশি দর্শকদেরকে পরিচিত করছিল গীতিকার ও সুরকারের সঙ্গে।
সঙ্গীতায়োজনের শুরুতে মেধাবী কিশোর নুরাজের স্বাগত বক্তব্যটি ছিল মনকাড়া। শিশুশিল্পী স্নেহা ও আরওয়ার পরিবেশনাও ছিল হৃদয়গ্রাহী। সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয়ে রাত ন’টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার অখন্ড এই সঙ্গীতায়োজনটি উপভোগ করে সেদিন দর্শকেরা বাড়ি ফেরেন এক অনুপম মুগ্ধতা নিয়ে।
