আজজা রাদওয়ান সেদকি :
২০০৯ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন ‘ব্রিক’ নামে একটি রাষ্ট্রীয় জোট গঠন করে। এর পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকাও এ জোটে যোগ দিলে এর নতুন নাম হয় ‘ব্রিকস’। বর্তমানে ব্রিকস গ্রুপ পশ্চিমের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর বাইরে একটি শক্তিশালী জোটে পরিণত হয়েছে।
প্রথম দিকে অবশ্য প্রতিপক্ষরা এ জোটকে নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায়নি। ব্রিকসের সফলতা নিয়েও তারা সন্দিহান ছিল। তবে এর বৈচিত্র্য ও জোটের মূল সদস্যদের ভিন্নতা সত্ত্বেও ব্রিকস আজ এক শক্তিশালী জোট। বিশ্বের প্রায় ২৮ শতাংশ ভূখণ্ডজুড়ে এর ব্যাপ্তি, যেখানে বিশ্বের ৪৫ শতাংশ মানুষের বসবাস। সব মিলে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো বিশ্বের ২৫ শতাংশ জ্বালানি তেল এবং ইস্পাত তৈরিতে ৫০ ভাগ আকরিক লোহা উৎপাদন করে থাকে। এছাড়া বিশ্বের ৪০ শতাংশ ভুট্টা এবং ৪৬ শতাংশ গমও এ জোটভুক্ত দেশগুলোয় উৎপন্ন হয়ে থাকে। এসব কারণে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো তাদের প্রভাব ও উপস্থিতির জানান দিতে পেরেছে।
ব্রিকস গ্রুপের উদ্দেশ্য দুটি : এর সদস্যদের জাতীয় স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়া এবং স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা। এ প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমা আধিপত্যের মোকাবিলা করা। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার পটভূমিতে ব্রিকস জোটের সম্প্র্রসারণের গতি বাড়ছে।
২০১৪ সালে ব্রিকস দেশগুলো বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিকল্প হিসাবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (নতুন উন্নয়ন ব্যাংক) চালু করে এবং নতুন সদস্যদের জন্য তাদের দুয়ার খুলে দেয়। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মূলধন নিয়ে, যার ২০ শতাংশ দিয়েছিল ব্রিকস জোটের দেশগুলো, যা ১০ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের।
২০২১ সালে, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উরুগুয়ে ও বাংলাদেশ নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে শেয়ার গ্রহণ করে। তবে এ শেয়ারের মূল্য ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের বিনিয়োগকৃত ১০ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে অনেক কম ছিল। তার পরও সহযোগিতার একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হওয়ায় অনেক দেশ এখন ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, মিসর, সৌদি আরবসহ অনেক রাষ্ট্র।
মিসরের রাষ্ট্রপতি আবদেল-ফাত্তাহ আল-সিসি সম্প্রতি নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক সংক্রান্ত একটি চুক্তি অনুমোদন করেছেন, যাতে মিসর এ জোটে যোগ দিতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ মিসরের জন্য একটি বড় পরিবর্তন এবং এটি মার্কিন ডলারের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছে। মিসরের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের অর্থনীতিবিষয়ক কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদেল-হামিদ বলেছেন, ‘ব্রিকস গ্রুপের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে মিসরের যোগদান রাষ্ট্রীয় বাজেটকে দেশের আমদানি মেটাতে মার্কিন ডলার খোঁজার চাপ থেকে মুক্তি দেবে। কারণ ব্যাংকের সদস্যরা তাদের জাতীয় মুদ্রা বাণিজ্য বিনিময়ের জন্য ব্যবহার করতে পারে।’
এটি একটি মৌলিক পরিবর্তন এবং অনেক দেশ তা অর্জনের আশা করে। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সব দেশ তাদের নিজস্ব মুদ্রা শক্তিশালী করতে চাচ্ছে এবং ব্রিকস গ্রুপ সেই লক্ষ্য অর্জনে তাদের সাহায্য করতে পারে। এটি এমন এক বিকল্প ব্যবস্থা, যা এ দেশগুলোকে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের তীব্র ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।
২০২২ সালে ১৪তম ব্রিকস সম্মেলনের সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছিলেন, ব্রিকস দেশগুলো এমন এক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করবে, যা দিয়ে একটি নতুন বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা চালু করা যাবে। এটি মার্কিন ডলারের আধিপত্যের জন্য সরাসরি হুমকি হবে এবং এর আধিপত্য খর্ব করতে সাহায্য করবে।
বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ ডি-ডলারাইজেশনের প্রবণতায় একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসাবে চিহ্নিত করতে পারে। কারণ দেশগুলো ডলারকে বাদ দিয়ে অন্য মুদ্রায় বাণিজ্য করার চেষ্টা করছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টাও আছে। যদি ব্রিকস দেশগুলোর পণ্য ও পরিষেবাগুলো নতুন রিজার্ভ মুদ্রায় লেনদেন করা হয়, তাহলে তা নতুন বিশ্ব অর্থনীতির ভিত্তি হয়ে উঠবে এবং এটি একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার উত্থান ঘটাতেও সাহায্য করবে।
নানা অপ্রত্যাশিত ঘটনা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে নানাভাবে আন্দোলিত করছে। রাশিয়া এখন আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চীনের মুদ্রা (ইউয়ান) ব্যবহার করছে এবং ইউয়ান এখন রাশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করা মুদ্রা। ব্রাজিল ও চীন তাদের নিজস্ব মুদ্রার ব্যবহারে মার্কিন ডলারকে বাদ দিচ্ছে। অর্থ প্রদানের জন্য ইউয়ান ব্যবহার করার বিষয়ে সৌদি আরব বেইজিংয়ের সঙ্গেও আলোচনা করছে। এসব স্পষ্টতই মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
মার্কিন কোম্পানি মাইলস ফ্রাঙ্কলিন প্রিসিয়াস মেটাল ইনভেস্টমেন্টসের সিইও অ্যান্ডি শেক্টম্যান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, সৌদি আরবের এখন এমন একটি ঘোষণা দেওয়া বাকি আছে যে, ‘আমরা এখন তেলের জন্য অন্যান্য মুদ্রা নেওয়ার কথা ভাবতে চলেছি; এবং হঠাৎ করেই দেখবেন যেসব দেশ গত ৫০ বছর ধরে ডলার ধরে রেখেছিল, তারা আর তা ধরে রাখার আগ্রহ দেখাবে না। আর তারা সবাই যদি ডলার আঁস্তাকুড়ে ফেলতে শুরু করে এবং আমি মনে করি এটি দ্রুতই ঘটবে, তাহলে এর প্রভাবে পশ্চিমে মুদ্রাস্ফীতির সুনামি দেখা দেবে।
এছাড়া ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিকস গ্রুপের রাজনৈতিক অবস্থানও শক্তিশালী হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ব্রিকস সদস্যরা এ যুদ্ধের ব্যাপারে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেদের আরও দূরে সরিয়ে নিয়েছে। ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে কেউই অর্থাৎ ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। এ ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি স্বতন্ত্র পার্থক্য লক্ষ করা যাচ্ছে।
জার্মান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্প্রচারমাধ্যম ডয়েচে ভেলের সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘ইউরোপীয় এবং মার্কিন নীতিনির্ধারকরা এ কারণে উদ্বিগ্ন যে, ব্রিকস যতটা না বিশ্বের উদীয়মান শক্তিগুলোর একটি অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হতে পারে, তার চেয়ে বেশি পরিণত হতে পারে এ দেশগুলোর কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদ দ্বারা সংজ্ঞায়িত একটি রাজনৈতিক জোটে।
মিসরের আল আহরাম উইকলি থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস
আজজা রাদওয়ান সেদকি : সাবেক অধ্যাপক, কানাডা