আল আজাদ :
সিলেট সিটি করপোরেশন-সিসিক নির্বাচনে ভোটযুদ্ধে আলোচনায় থাকা দুই মেয়র প্রার্থীর মুখে প্রথমদিকে দু’টি কথা খুব জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছিল।
একটি হলো, ‘গত ২০ বছরে মহানগরীতে দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হয়নি। যা হয়েছে তা কেবল লোক দেখানো। উন্নয়নের নামে হরিলুট হয়েছে।’ অপরটি ছিল, ‘পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি। হয়েছে ‘কসমেটিক’ উন্নয়ন। ফলে বর্তমান সরকারের দেওয়া বরাদ্দকৃত বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে।’
প্রথম বক্তব্যটির সঙ্গে কোনোভাবেই একমত হওয়া যায়না। যাওয়ার কথাও নয়। কারণ চোখের দেখাকে তো অস্বীকার করা যায়না। অবশ্যই উন্নয়ন হয়েছে। প্রশ্ন থাকতে কতটুকু উন্নয়ন হলো। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, জনপ্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে। এছাড়া হরিলুট চালাতে হলেও কিছু উন্নয়ন করতে বা দেখাতে হয়। জনগণের অর্থাৎ সরকারের বা দাতাদের থেকে টাকা উড়ে আসেনা। আসে উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকূলে। তাই একেবারে কিছু না করে টাকা হজম করা যায়না।
এবার দ্বিতীয় বক্তব্যটির ভিতরে ঢোকা যাক। তাতে যা বলা হচ্ছিল তা আধাআধি সত্য-এটা মানতেই হবে। কারণ এতে উন্নয়নকে অস্বীকার করা হয়নি। তবে এটাও শতভাগ সত্য যে, অনেক উন্নয়ন কাজ ছিল অপরিকল্পিত। এমনও শোনা গেছে যে, এই কর্মগুলো সাধিত হয়েছে কর্তার ইচ্ছায় এবং পছন্দের লোকজনকে দিয়ে। তাই প্রকল্প-পরিকল্পনার লেশমাত্র ছিলনা। সুতরাং অর্থের অপচয়ের অভিযোগকে উড়িয়ে দেওয়া যাবেনা। ‘কসমেটিক’ উন্নয়ন বা বাহ্যিক সৌন্দর্য বর্ধন হয়নি তা কিন্তু নয়। হয়েছে। তবে এ ধরনের উন্নয়নের প্রয়োজন যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়।
এ প্রসঙ্গে বয়সে তরুণ সিসিকের গত ২০ বছরের জীবন নিয়ে কিঞ্চিৎ ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক। প্রথম এবং পরপর দুই মেয়াদে মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগের বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপি। একেতো সূচনালগ্ন তারউপর সরকারের বৈরী আচরণ তাকে রীতিমতো কোণঠাসা করে রেখেছিল। তারউপর নগর উন্নয়নের নামে বিশেষ কমিটি গঠনের ফলে সিসিক দ্বৈত প্রশাসনিক যাঁতাকলে পড়ে যায়।
এখানেই শেষ নয়, ২০০৪ সালে একাধিকবার গ্রেনেড-বোমা দিয়ে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে হত্যার চেষ্টা করে জঙ্গিগোষ্ঠী। এ অবস্থায় মেয়রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ছিল রাষ্ট্রক্ষমতায়। এই সময়ে ‘দিন বদলের সনদ’ অনুযায়ী সবকিছু নতুন করে শুরু করা হয়। বরাদ্দ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন কাজ পরিচালিত হতে থাকে মেয়রের নেতৃত্বে। তবে নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ যে অনেক ক্ষেত্রেই হয়নি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যথেষ্ট অপচয়ও হয়েছে।
গত ১০ বছর ধরে মেয়র বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী। রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ; কিন্তু তিনি কখনও সরকারের বিরুদ্ধে বৈরী আচরণের অভিযোগ করেননি। অকল্পনীয় আনুকূল্য পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড এ কে আব্দুল মোমেনের। ফলে সরকার দলের স্থানীয় অনেক নেতা ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে। তবে এই সময়ে উন্নয়ন হয়েছে অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। আয়তন বেড়েছে সিসিকের।
একই সঙ্গে হয়েছে ’কসমেটিক’ উন্নয়নও, যা দেখে কেউ কেউ লন্ডনে বসবাসের সাধ মিটিয়ে নিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কাজ হয়েছে অবৈধ দখল উচ্ছেদে। এ জন্যে আরিফুল হক চৌধুরীকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে এই সময়ে অপরিকল্পিত প্রচুর কাজ যে হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবেনা। এর কুফল বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ অসমাপ্ত থাকা এবং দলীয় সমর্থক অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সিসিক সম্প্রসারণের অভিযোগও আছে। তবু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ’ভাল মানুষ, কাজ করে’ বলে প্রশংসা করেছিলেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী কি করবেন। প্রথমেই তাকে নজর দিতে হবে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দিকে। কারণ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি দ্রুত চিহ্নিত করতে হবে অপরিকল্পিত কাজগুলো। এগুলোকে যথাসম্ভব পরিকল্পনার মধ্যে এনে সম্পন্ন করতে হবে। প্রয়োজনে বাতিল করে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে।
আপাতত এতটুকই চাওয়া থাক তার কাছে। দেখা যাক তিনি কিভাবে প্রথম ’একশ দিনের পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করেন।