মুহাম্মদ সাজিদুর রহমান :
বঙ্গবন্ধু এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম তাঁর স্বাগত বক্তব্যে বলেছেন, “বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তাঁর অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। এই নৃশংস হত্যাকান্ড মানব ইতিহাসের নজিরবিহীন বর্বরতার ঘটনা এবং ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের চরম লঙ্ঘন – যা আব্রাহাম লিঙ্কন, মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং এবং জন এফ কেনেডি-এর মতো অন্যান্য সমসাময়িক নেতাদের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।”
হাইকমিশনার বলেন, “সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ছোট বোন শেখ রেহানা ওই সময় বিদেশে থাকায় হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যান এবং আজও বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।” হাইকমিশনার বলেন ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম যুক্তরাজ্য সফর একটি প্রগতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য বন্ধুত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছে। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ এবং বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে তরুণ প্রজন্মের ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের অনুপ্রেরণা নেয়ার আহ্বান জানান।
গতকাল ১৫ আগষ্ট ইষ্টলন্ডনের ইমপ্রেশন ভ্যানুতে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গহর রিজভী বিশেষ অতিথি ছিলেন আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সুলতান মাহমুদ শরীফ, বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন, লন্ডন অ্যাসেম্বলির সদস্য উমেস দেশাই, বিবিসির সাবেক সাংবাদিক ও লন্ডনভিত্তিক এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের সম্পাদক ডানকান বার্টলেট এবং ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষে নঈম উদ্দিন রিয়াজ।
প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল জাতির পিতার গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ব্যর্থ করে দেয়া এবং দেশকে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া।” আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. গওহর রিজভী আরো বলেন, “বঙ্গবন্ধুর মূল্যবোধের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এই সোনার বাংলা অর্জনের প্রচেষ্টায় প্রধানমন্ত্রীর হাতকে আরো শক্তিশালী করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।”
বিশেষ অতিথি বিশিষ্ট আিইনজীবি সুলতানা কামাল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন বঙ্গবন্ধুর ১০ বছর বয়সী নিষ্পাপ কনিষ্ঠ পুত্রকে নির্মমভাবে হত্যার বর্ণনা দিয়ে বলেন, এই হত্যাকাণ্ড ছিল মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। যারা এখনও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বাংলাদেশকে ভিন্ন পথে চালিত করতে চায় তাদের সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডানকান বার্টলেট একই অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, “বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলা। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র দুটি উল্লেখযোগ্য কারণে ব্যর্থ হয়। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর মূল্যবোধ আজো তাদের অনুপ্রাণিত ও পথ-প্রদর্শন করছে যারা তাঁর উত্তরাধিকারকে সমুন্নত রাখতে চায়। দ্বিতীয়ত:, বাংলাদেশের অসাধারণ অর্থনৈতিক অগ্রগতি যার পেছনে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও চেতনায় পরিচালিত নেতৃত্ব। দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে একটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য অর্থনৈতিক পারফরমার হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাহমুদ শরীফ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য নেতৃতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশের চলমান অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। পরে পবিত্র কোরান, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। হাইকমিশনার অতিথিবৃন্দ এবং মিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর তিনি অতিথিদের নিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডনের স্মারক প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্মীত বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী মুনিরা বেগম এবং বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডনের কাউন্সিলর দেওয়ান মাহমুদুল হক বঙ্গবন্ধু ও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি নিবেদিত বিশিষ্ট কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রখ্যাত কবিতা আবৃত্তি করেন।
সকালে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম হাইকমিশন প্রাঙ্গণে মিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের নিয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন । এরপর জাতির পিতাসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ ও জাতির পিতার ও তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।