মুহাম্মদ সালেহ আহমেদ ,
অনলাইন ডেস্কঃ
সংসদের পুরোনো ভবনকে অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় জানিয়ে মঙ্গলবার নতুন ভবনে প্রথম অধিবেশন শুরু হলো। আর তার সঙ্গেই ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের যবনিকা পড়ল। শুরু হলো নতুন ইতিহাস। নতুন সংসদ ভবনের নাম রাখা হয়েছে ‘পার্লামেন্ট হাউজ অব ইন্ডিয়া’। পুরোনো ভবনের নাম হবে ‘সংবিধান সদন’। ভারত বনাম ইন্ডিয়া নাম পরিবর্তনের বিতর্কের মধ্যে নয়া সংসদ ভবনে ‘ইন্ডিয়া’র নাম অটুট থাকাও কম চমক নয়।
মঙ্গলবার ( ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩) নয়াদিল্লির নতুন সংসদ ভবনে অধিবেশন শুরুর আগে সেন্ট্রাল হলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘নতুন সংসদ ভবনের হাত ধরে নতুন ভবিষ্যতের সূচনা হলো।’ লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা বলেন, ‘নতুন সংসদ ভবন সবার জন্য নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসবে।’
সোমবার পুরোনো সংসদ ভবনের শেষ অধিবেশন ছিল। ৯৬ বছরের পুরোনো ভবন নিয়ে আবেগতাড়িত ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বলেন, ১৯২৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৫০০ এমপি পুরোনো ভবনে বসেছেন। তাদের প্রত্যেকের প্রতিই শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন তিনি। ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট লুটিয়েনের তৈরি ওই গোল ভবনে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে প্রথম স্বাধীন ভারতের বক্তৃতা দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। আর শেষ ভাষণ দিলেন নরেন্দ্র মোদি। ওই ভবনেই ভারতীয় সংবিধান গ্রহণ করা হয়। বস্তুত, জায়গার অভাব এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণেই নতুন সংসদ ভবন তৈরি করা হয়েছে। তিন কোনা নতুন ভবন পুরোনো ভবনের চেয়ে অনেকটাই আলাদা দেখতে। সব ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার আছে নতুন ভবনে। সব এমপির জন্য আলাদা চেম্বারও রাখা হয়েছে নতুন ভবনে।
মঙ্গলবার পুরোনো ভবনের সেন্ট্রাল হলে একটি বিদায়ি অনুষ্ঠানে দেশটির তিন বর্ষীয়ান রাজনীতিক বক্তৃতা দেন। তারা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার নেতা শিবু সোরেন এবং বিজেপি সংসদ-সদস্য মানেকা গান্ধী। পুরোনো ভবনে সব এমপিকে নিয়ে ফটোসেশনের পর প্রধানমন্ত্রী মোদি সংবিধানের একটি কপি হাতে নিয়ে নতুন পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন। পেছনে ছিলেন বাকি সব এমপিরা।
রীতিমতো ঢেলে সাজানো হয়েছে ভারতের নতুন সংসদ ভবনের অন্দরমহল। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের বিখ্যাত উপকরণ নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন সংসদ ভবন। নাগপুরের সেগুনকাঠ থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর থেকে আনা কার্পেট! কী নেই সেখানে।
২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। নয়া সংসদ ভবনের ভূমিপূজা এবং শিলান্যাস করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রায় আড়াই বছর ধরে চলেছিল ভবন নির্মাণের কাজ। এরপর ২০২৩ সালের ২৮ মে উদ্বোধন হয়েছিল নতুন সংসদ ভবনের। উদ্বোধনের আগে ভবনের মাটি ছুঁয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেছিলেন মোদি। সেই সংসদ ভবনেই এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করলেন এমপিরা। দুপুর ১টা ১৫ মিনিট থেকে নতুন লোকসভা ভবনে শুরু হয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন।
‘গণেশ চতুর্থী’র দিনে নতুন ভবনে প্রবেশকে কেন্দ্র করে এদিন সকাল থেকেই প্রস্তুতি ছিল তুঙ্গে। নতুন সংসদ ভবনে প্রবেশের আগে পুরোনো সংসদ ভবনের সামনে ‘ফটোসেশন’ করেন সংসদ-সদস্যরা। মধ্যমণি হয়ে ছবি তুলতে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। পরে পুরোনো সংসদ ভবন থেকে নতুন সংসদ ভবনে সংবিধান নিয়ে প্রবেশ করেন মোদি। নতুন সংসদ ভবনের নাম ‘পার্লামেন্ট হাউজ অব ইন্ডিয়া’।
নতুন সংসদ ভবনের মোট ছয়টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। আর সেই ছয় দরজায় পাহারায় রয়েছে ছয় ‘বিশেষ’ রক্ষী। কয়েকটি বাস্তবের এবং কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনির প্রাণীর মূর্তি বসানো হয়েছে ছয়টি দরজায়। প্রত্যেকটি মূর্তি সংসদের বিভিন্ন দিক নির্দেশ করে। এই ছয়টি প্রবেশদ্বার হলো, গজদ্বার, অশ্বদ্বার, গরুড়দ্বার, মকরদ্বার, শার্দূলদ্বার এবং হংসদ্বার। প্রতিটি দরজায় একটি করে প্রাণীর ভাস্কর্য রয়েছে। সেই অনুযায়ী দরজাগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। গজদ্বারের নামকরণ করা হয়েছে হাতির নামে, যা বুদ্ধি, স্মৃতি, সম্পদ এবং প্রজ্ঞার প্রতিনিধিত্ব করে। এই দরজাটি ভবনের উত্তর দিকে। বাস্তুশাস্ত্র অনুযায়ী, উত্তর দিক বুধের সঙ্গে যুক্ত এবং বুদ্ধির উৎস বলে। নতুন সংসদ ভবনের তৃতীয় প্রবেশদ্বারের নাম রাখা হয়েছে গরুড়দ্বার। এটি সংসদ ভবনের পূর্বদিকের প্রবেশদ্বার। পৌরাণিক মতে গরুড় পক্ষীরাজ। গরুড়কে বিষ্ণুর বাহন বলে মনে করা হয়। গরুড়কে ধর্ম এবং কর্তব্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়। পঞ্চম দরজার নাম শার্র্দূল দ্বার। যা আরও একটি পৌরাণিক প্রাণীর নামানুসারে তৈরি হয়েছে। শার্দূলের শরীর সিংহের, কিন্তু মাথা ঘোড়া, হাতি বা তোতাপাখির। নতুন সংসদ ভবনের গেটে শার্দূলের উপস্থিতি দেশের জনগণের শক্তির প্রতীক। হংসদ্বার সংসদের ষষ্ঠ এবং অন্তিম দ্বার। রাজহাঁসের নামে নামকরণ করা হয়েছে এই দ্বারের। পুরাণ অনুযায়ী, হংস হলো জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর বাহন। মনে করা হয় হংস মোক্ষ, আত্ম-উপলব্ধি এবং প্রজ্ঞার প্রতীক। এই ছয়টি দ্বার ছাড়াও ঢেলে সাজানো হয়েছে সংসদ ভবনের অন্দরমহল। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিখ্যাত উপকরণ নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন সংসদ ভবন।
নতুন সংসদ ভবন নির্মাণে দেশজুড়ে বিভিন্ন রাজ্যের নামিদামি শিল্পকর্মের ব্যবহার করা হয়েছে। ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ এর ধারণাকে তুলে ধরতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। রাজস্থানের সরমথুরা থেকে লাল এবং সাদা বেলেপাথর এনে তৈরি হয়েছে সংসদ ভবনের একাংশ। লালকেল্লা এবং হুমায়ুনের সমাধি তৈরিতে ব্যবহৃত বেলেপাথরও সরমথুরা থেকেই আনা। ভবনটিতে ব্যবহৃত সেগুনকাঠ আনা হয়েছে মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে। সংসদের গালিচাগুলো উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর থেকে আনা।
নতুন সংসদ ভবন তৈরিতে ব্যবহৃত কেশরিয়া সবুজ মার্বেল পাথর উদয়পুর, লাল গ্রানাইট পাথর অজমেরের লাখা এবং সাদা মার্বেল পাথর রাজস্থানের আমবাজি থেকে আনা। ভবনের ভেতরে থাকা সব আসবাবপত্র তৈরি হয়েছে বাণিজ্য নগরী মুম্বাইয়ে।
উচ্চ এবং নিম্নকক্ষের (রাজ্যসভা এবং লোকসভা) ‘ফলস সিলিং’ তৈরিতে ব্যবহৃত ইস্পাতের কাঠামো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দমন এবং দিউ থেকে আনা। ভবনের পাথরের ‘জালি’র কাজগুলো রাজস্থানের রাজনগর এবং উত্তরপ্রদেশের নয়ডা থেকে আনানো হয়েছিল। নতুন সংসদ ভবনে থাকা অশোকস্তম্ভে ব্যবহৃত উপকরণগুলো মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ এবং রাজস্থানের জয়পুর থেকে আমদানি করা।
নতুন লোকসভা হলে মোট আসনের সংখ্যা ৮৮৮। নতুন সংসদের নিম্নকক্ষের নকশা ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূরের থিমের ওপর তৈরি করা হয়েছে। উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার অন্দরের নকশা তৈরি হয়েছে জাতীয় ফুল পদ্মের থিমে। রাজ্যসভা হলের মোট আসন সংখ্যা ৩০০টি। সংসদ ভবনে পাকাপাকিভাবে স্থান পেতে চলেছে স্বর্ণদণ্ড ‘সেঙ্গল’। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে সেটিকে স্পিকারের চেয়ারের সামনে রাখা হবে। তবে এই সেঙ্গল নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক।