আলাউদ্দিন আহমেদ : আমাদের মানস-আশ্রয় , সংবেদনশীল শিক্ষক
ডক্টর আবুল ফতেহ ফাত্তাহ
::
চেতনার আলোকবিন্দুতে দাঁড়িয়ে তিনি সংবেদনশীল সংরাগে আমাদের মনোভূমি বহুবর্ণিল করে তুলতেন। পাঠদানের বিষয় আনন্দ-উপাদানে শিক্ষার্থীমনে কতোটা হৃদয়গ্রাহী ও রুচিস্নিগ্ধ পেলবরসে বিস্তারলাভ করে, সেই কৃৎকৌশল তাঁর রপ্ত ছিল। তিনি আলাউদ্দিন আহমেদ, আমার প্রিয় শিক্ষক এবং আমাদের মানস-আশ্রয়। ১৯৬৭ সালে বাউশা প্রাইমারি স্কুল (১৮৮৫) থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাশ করে পুনরায় চতুর্থ শ্রেণিতেই ভর্তি হই , নবীগঞ্জ যুগল-কিশোর হাইস্কুলে (১৯১৬)। উদ্দেশ্য, হাইস্কুলে শক্ত ভিত নিয়ে অধ্যয়ন। কারণ সে-সময় শিক্ষা-সংস্কৃতি,ক্রীড়া ও রাজনৈতিক চেতনার তীর্থরূপে সবমহলে নন্দিত ছিল এই প্রতিষ্ঠান। অভিভাবকমহলেও ওই স্কুল নিয়ে উচ্চধারণার অবধি ছিল না। এই সূত্রে আমি কিংবা আমাদের অনেককে ক্লাশ ফোরে অনার্স(অর্থাৎ দু বছর) পড়তে হয়েছে।
স্কুল-শিক্ষকদের বিদ্যাপ্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব,নীতিনৈতিকতা ও আত্মসম্মানবোধ শুধু শিক্ষার্থীমন আকর্ষণ করত না ; অভিভাবক ও জনমনে এর প্রভাব ছিল ঈর্ষণীয়। আবদুল আজিজ চৌধুরী, চারুচন্দ্র দাশ প্রমুখ প্রধান শিক্ষক সে-সময়কার কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব। তাঁদের চলাফেরা,শাসন ও ব্যক্তিরুচি,স্নেহচ্ছায়া সকলের অনুসন্ধিৎসার বিষয় ছিল। আলাউদ্দিন আহমেদও ছিলেন এই দুজনের ছায়াসঙ্গী ও ভাবশিষ্য। তবে তিনি অপেক্ষাকৃত শান্ত, নিরবিলি,পঠনপ্রিয় ও সংবেদনশীল ছিলেন। শিক্ষার্থীবান্ধব আন্তরিক অভিপ্রায় তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল।আমাদের পাঠরুচি সৃষ্টির নেপথ্যকারিগর ছিলেন আলাউদ্দিনস্যার, মৌলবি আবদুস সাত্তারস্যার। তাঁদের অন্তরছোঁয়া অভিব্যক্তি আমাদের আকর্ষণের বিষয় ছিল। অন্যসব শিক্ষকও ছিলেন আমাদের স্বপ্নসারথি। এই ছিল আমাদের মাধ্যমিক স্কুলজীবনের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট।
২
আজ আলাউদ্দিনস্যারকে নিয়ে আমার চেতনার দেউড়িজুড়ে হরেক রকম স্মৃতির ভিড়। একজন পরিশীলিত মনের সহজ মানুষ তিনি। শ্রেণিকক্ষ,স্কুল-আঙিনা, খেলার মাঠ, পারিবারিক গণ্ডী,সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, বইপড়া ও গল্প-আসরে স্যারের বহুমাত্রিক রসবোধ সবার আকর্ষণবিন্দু ছিল। সর্বোপরি তাঁর উন্নত রুচি ও মানবিক বোধ সবাইকে কাছে টানত। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, আলাউদ্দিনস্যার যেকোনও সংকটময় মুহূর্তে নিজেকে সংযত ও সংহত রাখতে পারতেন। এই বিরল গুণের জন্য স্যারকে আমরা খুব সমীহ করতাম। কোনওদিন খুব একটা রাগতেও দেখিনি। তাঁর ঠোটের কোনে মৃদু হাসির ঝিলিক খেলা করত। আমরা তখন দশম শ্রেণিতে। স্যার এলেন ক্লাশ নিতে। আমরা সবাই স্যারের কথা শোনায় উৎকর্ণ। বাংলার ক্লাশ। রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে স্যার কথা বলছিলেন । হঠাৎ পেছনের সারিতে স্যারের নজর পড়ল। কিছুটা গম্ভীর অথচ রসকৌতুকের সঙ্গে বললেন , বঙ্কিমচন্দ্রের নাম শুনেছ? তাঁর একটি রচনার একটা লাইন আমি তোমাদের শুনাব। এই বলে তিনি বাক্যটা উচ্চারণ করলেন —
‘ মৎস্য বিপণীতে গেলাম। দেখিলাম, চুনুপুটি হইতে আরম্ভ করিয়া রুই-কাতলা পর্যন্ত লেজ নাড়িয়া নাড়িয়া খরিদদারদিগের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছ। ‘
স্যারের এই মন্তব্য শুনে শ্রেণিকক্ষে পিনপতন নীরবতা। ছাত্রছাত্রী সবাই বুঝে গিয়েছিল কাকে লক্ষ্য করে স্যার এই মন্তব্য ছুঁড়েছিলেন। এরপর স্যার উদ্দিষ্ট রবীন্দ্রনাথে ফিরে আসেন। রাগ না-করে প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে পুনরায় মূলবিষয়ে ফিরে আসার কৌশল ও সক্ষমতা স্যারের প্রবল ছিল।
রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র-সাহিত্যের প্রতি স্যারের অনুরাগ দেখে আমরা বিস্মিত হতাম। রবীন্দ্রকাব্যের ভাববৈচিত্র্য ও দর্শন প্রেমরসের খেয়ায় নিসর্গনির্ভর রূপমাধুর্যে মানবমনকে আন্দোলিত করে। স্যার তাঁর প্রাণের তাগিদ থেকে কবির কাব্যের বহুবিচিত্র ভাবানুষঙ্গ ও প্রেমবিহ্বল ছায়াচিত্র শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপনে সচেষ্ট ছিলেন। সাহিত্য- সংকলনের পাশাপাশি ভাষাজ্ঞান,ভাবসম্প্রসারণ তথা সৃজনমেধার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টিতে স্যারের নিরলস শ্রম, সময় ও অনুধ্যান আমাদের ঋদ্ধ করেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ থেকে বিখ্যাত কবিতাংশ তিনি আমাদের শ্রুতিলিখন পদ্ধতিতে সরবরাহ করতেন। গৃহকোন অধ্যয়নরূপে নির্দিষ্ট খাতায় আমরা সারাংশ-ভাবসম্প্রসারণ লিখে স্যারকে ক্লাশে দেখাতাম। তিনি আমাদের দুর্বল লেখাগুলো পরম মমতায় ঠিক করে দিতেন। আবার উৎসাহও দিতেন। ‘ ‘সোনার তরি’ , ‘এবার ফিরাও মোরে ‘,
‘যেতে নাহি দিব ‘, ‘ ক্যামেলিয়া ‘, ‘বাঁশি’ প্রভৃতি কবিতা পড়ে পড়ে এবং বিশ্লেষণ করতে যেয়ে আমাদের মনে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। আর আমাদের এই সাহিত্য-উজ্জীবনের সারথি হলেন আলাউদ্দিনস্যার। অথচ,স্যারের অধীত বিষয় সাহিত্য ছিল না। তিনি ছিলেন মূলত কমার্স গ্রাজুয়েট। সাহিত্যরুচি তাঁর শখ বা নেশা ছিল।
৩
মাধ্যমিক স্কুল পেরিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য বিষয়ে অধ্যয়ন করেছি। অনেক খ্যাতিমান শিক্ষকের নিবিড় সান্নিধ্যলাভে ধন্য হয়েছি। কিন্তু সবার প্রজ্ঞাদীপ্তি আমাকে টানলেও আলাউদ্দিন আহমেদস্যার যেন সবার অলক্ষ্যে আমার মনের জানালাপথে পথ আগলে দাঁড়ান, বিচিত্র ভঙিমায়! কারণ স্যারের কণ্ঠে শুনতে পাই —
সতত হে নদ,তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমারি কথা ভাবি এ-বিরলে!
—তখন আমার অনুভবজুড়ে মধুসূদন দত্তের সেই কপোতাক্ষ নদের কুলু কুলু ধ্বনি হৃদয়মনকে বিষাদ-ছায়ায় আকীর্ণ করে। কবির দুঃখবোধের অংশীজনরূপে আমার স্যারের কণ্ঠস্বর আমার বা আমাদের কানে বেদনার ধারাপাত হয়ে ধরা দেয়। আমিও তখন স্মৃতি-সাঁকোয় পাড়ি দিই গহরপুর,গন্ধা, জেকে স্কুল আঙিনা,শ্রেণিকক্ষের বন্ধুদের বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখমুখ।স্যারের চোখের কোনের জলবিন্দু বুকের ভেতরে হাহাকার তোলে। বলা যায়, এ-আমার অতিরেক আবেগ!
অন্য একদিন স্যারের কণ্ঠে বেজে ওঠে—
তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী
আমি অবাক হয়ে শুনি—
অথবা,
দরদি,দরদি গো, কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম
সাধের প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে নিজেই পুড়ে গেলাম …
স্যারের মনের ভেতর কবিতা-গান আবেগমথিত ভাষায় ফুটে উঠত। ওই বয়সে কবিতা বা গানের পঙক্তি কতটা প্রভাব ফেলেছে জানি না। তবে তাঁর শিক্ষার্থীদের ঘিরে স্যারের প্রশান্ত মন কাব্যগানে মুখর ছিল, বলা যায়।
আরেকদিনের কথা, স্যারের মনটা কেন জানি একটু বিষণ্ন ছিল। তাঁর কণ্ঠে বেজে ওঠে —
থাক স্বর্গ হাস্যসুখে কর সুধা পান
দেবগণ! স্বর্গ তোমাদের সুখস্থান
মোরা পরবাসী!
—এই কবিতার বিশ্লেষণে স্যারের মুখ দিয়ে যে অভিব্যক্তি ও আবেগ প্রকাশ পায়, চিরকাল আমার স্মরণে থাকবে। বাংলার শিক্ষকদের ক্লাশের ফাঁক গলিয়ে আমার সেই স্যারের আবেগি সংলাপে আমি আনমন হয়ে যেতাম। কতটা প্রাণাবেগ নিয়ে স্যার আমাদের পড়াতেন, এখন সেটা টের পাই। স্যারের বাচনিতে যখন শুনতে পেতাম —
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ
সমস্ত পৃথিবী…
তখন স্যারের মনোজগৎ বুঝে ওঠার বয়েস ও বুদ্ধিমত্তা আমাদের হয়ে উঠিনি।আরেকদিনের কথা, রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতার হরিপদ কেরাণির দারিদ্র্য ও বিরহকাতর মনের সংবেদনশীল বয়ান স্যারের বাচনিতে অপূর্ব শোনাচ্ছিল। মাথা নেড়ে ব্যথাতুর কণ্ঠে স্যারের উচ্চারণ খুব হৃদয়স্পর্শী ছিল। নির্মিলিত চোখে স্যারের কম্পিত কণ্ঠ বেজে ওঠে বিবাগী সুর —
ঘরেতে এল না সেতো মনে তার নিত্য আসা- যাাওয়া/ পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর!
কোনও এক বর্ষা-বাদল দিন। বৃষ্টির দাপটে আমরা শ্রেণিকক্ষের ভেতর আকাশকুসুম স্বপ্নবিভোর। সুনীলদার ঘণ্টাধ্বনি। অতঃপর শ্রেণিকক্ষে আলাউদ্দিনস্যারের আগমন। গতানুগতিক ক্লাশ হলেও স্যারের মনে পেজা মেঘের ভেলা। ‘বর্ষার কবি রবীন্দ্রনাথ’ —এই বলে স্যার ‘সোনাার তরি’ পড়া শুরু করেন। এক পর্যায়ে তাঁর কণ্ঠস্বর আর্দ্র হয়ে ওঠে। তিনি অনেক কষ্টে উচ্চারণ করেন,—
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোটো সে-তরি আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি/
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরি।
জীবনের শেষবেলা আর কৃষকের ফসলকাটার দৃশ্য, ভরাবর্ষার জলস্রোতে সোনার ফসল তলিয়ে যাবার শঙ্কা থেকে উদ্ধারচিন্তায় কৃষকমন কতটা চিন্তাক্লিষ্ট —আমাদের স্যার যেন সেই ব্যথাতুর জীবনচাষি! আজ এই বয়সে এসে এমনটি ভাবতে পারছি।
এইসব হৃদয়কাড়া উচ্চারণে আমরা বিমুগ্ধচিত্তে অনুরক্ত ছিলাম। তবু বাড়ির কাজ বলে ভাবসম্প্রসারণ করতে বসে মনে মনে ভাবতাম, আমাদের স্যার মধুসূদন-রবীন্দ্র-নজরুলের সব কবিতা বোধ হয় কণ্ঠস্থ করে ফেলেছেন। আর সেই ভাবরসে তিনি নিমজ্জিত। কিশোরমনে নিজের শিক্ষকের কৃতিকে বড়ো করে দেখার বা দেখানোর একটা প্রবণতা ওই বয়সেরই লক্ষণ। আমরা সেটা যাপন করেছি, পালন করেছি। এতে তৃপ্তি আছে; আছে মুগ্ধপ্রাণের অক্ষয় সঞ্চয়।
৪
আমার কীর্তিমান শিক্ষকদের ধারেকাছে হয়তো যেতে পারিনি। কিন্তু তাঁদের প্রিয়মুখ আমার বা আমাদের জীবনের ধ্রুবতারা। চলার পথে শিক্ষকপরিচয় দানের কৃতিত্ব যাঁদের প্রাপ্য তাঁরা আমার অগণন শিক্ষাগুরু। তাঁদের স্নেহচ্ছায়া, প্রজ্ঞা, প্রাণাবেগ,আদর-সোহাগ, স্বপ্ন-বাস্তবের হাতছানি আমাকে অজোপাড়াগাঁ থেকে নাগরিক কোলাহলে , অঙন থেকে উন্মুক্ত প্রান্তরে নিয়ে আসে। কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁদের অবদানকে স্মরণ করি। বিশেষত যুগল- কিশোর হাইস্কুলের খ্যাতিমান শিক্ষকদের মধ্যে উদ্যান ও পরিবেশবিদ রামদয়াল ভট্টাচার্য(পণ্ডিতস্যার) , সংস্কৃত ও বাংলা বিশারদ শৈলজা চক্রবর্তী, অংকবিদ অতুলচন্দ্র মহালদার , ইংরেজি ও ধর্মশিক্ষার শিক্ষক মৌলবি শামসুর রহমান খান, ভূগোলচিন্তক আবুল হোসেন চৌধুরী, গণিত ও ইংরেজির বিদ্বান রমেশচন্দ্র দে, অংক ও ইতিহাস-শিক্ষক আফরোজ বক্তচৌধুরী , বাংলা শিক্ষক গোলাম কাদির চৌধুরী ,ক্রীড়াবিদ ও ইংরেজি শিক্ষক সফিকুর রহমান চৌধুরী, ইংরেজি সাহিত্য ও আরবিশিক্ষক আবদুর রহিম চৌধুরী,কমার্স ও ইংরেজির শিক্ষক হাবিবুর রহমান, আবু সালেহ চৌধুরী, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হেমেন্দ্রচন্দ্র দাশ, বিজ্ঞান শিক্ষক অজিতকুমার পাল, ইংরেজি ও বাংলার নিবেদিত শিক্ষক প্রশান্তকুমার চক্রবর্তী,গণিত ও ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষক কৃষ্ণচন্দ্র নাথ, কমার্স ও ইংরেজির শিক্ষক আবদুল মতিন চৌধুরী, গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষক সনৎকুমার দাস, দিলীপকুমার রায়চৌধুরী, ইংরেজির প্রাণবন্ত শিক্ষক চন্দ্রকান্ত দাশ, বাংলার শিক্ষক নীহাররঞ্জন সরকার, ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষক মোহনলাল রায়প্রমুখ জ্ঞানী শিক্ষক এই স্কুলকে প্রজ্ঞাতীর্থে পরিণত করেন।
৫
শুরু করেছিলাম আলাউদ্দিনস্যারের পাঠদান-কৌশলের মুগ্ধতা নিয়ে। তাঁর ভেতর এক শিল্পিত মানুষের বসতি। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির অপূর্ব মিলবিন্যাসে তাঁর স্বভাব-ভঙিমায় যে উন্নত রুচি ও পরিশীলিত অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত, তা এই সমাজে বিরল দৃষ্টান্ত। সাহিত্যরসের ছোঁয়ায় তিনি শ্রেণিকক্ষে ভিন্ন এক পরিবেশ তৈরিতে সক্ষম ছিলেন। শৈলজা চক্রবর্তীস্যারের পরে আলাউদ্দিনস্যার স্কুল-গ্রন্থাগার পরিচালনার দায়িত্ব পান। শিক্ষার্থীদের পাঠরুচি ও পাঠাভ্যাস গড়ায় স্যারের আন্তরিক প্রয়াস ছাত্রছাত্রীদের মুগ্ধ করত। বিশেষত শিক্ষার্থীর বয়স ও ঝোঁক লক্ষ করে বইনির্বাচনে স্যার ছিলেন সতর্ক। তাই মেধাবী শিক্ষার্থী গড়ার পাশাপাশি তাদের মানস গড়ার ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম ভূমিকায় ছিলেন তিনি। স্কুলগণ্ডির বাইরেও আমাদের একটা স্টাডি সার্কেল ছিল। কে কী বই পড়ছেন, কার সংগ্রহে কী কী বই আছে ইত্যাকার তথ্য আমাদের জানা থাকত। সেই সুবাদে আমাদের অভিভাবক-শিক্ষক , সিনিয়র শিক্ষার্থী ও সমবয়েসিদের নিয়ে তিন- তিনটি অলিখিত স্টাডি সার্কেলে বইপড়া কর্মসূচি অব্যাহত থাকত। উন্নত ও পরিশীলন -প্রক্রিয়ায় এই অধ্যয়ন-প্রয়াসে আলাউদ্দিনস্যারপ্রমুখ ছিলেন নেপথ্য-সঞ্চালক।
বলছিলাম, স্যারের পাঠ-গভীরতা ও পাঠদান-কৌশল প্রসঙ্গে। সে-সময় নবীগঞ্জ যুগল-কিশোর হাইস্কুল ছিল প্রান্তিক জনপদের এক সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। উপাত্ত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আলাউদ্দিনস্যারের মত শিক্ষকেরা অনুসন্ধিৎসাগুণে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচোখ উন্মীলন এবং তাদের পাঠরুচি ও উন্নত সমাজসংস্কৃতির উৎসারণে নিবেদিত ছিলেন। তাঁদের এই নিরলস প্রয়াস-প্রচেষ্টা ধীমান প্রজন্মসৃষ্টির মহত্তম উদ্যোগ। শেষতক,আলাউদ্দিন আহমেদ স্যারসহ সকল শিক্ষকের অবিনশ্বর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : ডক্টর আবুল ফতেহ ফাত্তাহ
সাবেক অধ্যক্ষ- মদন মোহন সরকারি কলেজ, সিলেট
::
আকাশ-আঙিনা
সিলেট, ২৭ সেপটেম্বর, ২০২৩;
[প্রকাশিতব্য ‘ আলাউদ্দিন আহমেদ স্মারকগ্রন্থে’র জন্য লিখিত এই লেখাটি বিশ্ব-শিক্ষকদিবস উপলক্ষ্যে আলাউদ্দিন স্যারসহ সকল শিক্ষককে নিবেদন করেছেন — লেখক। ০৫ অক্টোবর, ২০২৩; ]