মুহাম্মদ শাহেদ রাহমান :
গ্রেট ব্রিটেনে ঐতিহাসিক এক দুর্গ ‘টাওয়ার অফ লন্ডন’ শুধুমাত্র রাজকীয় বাসভবনই নয়, এটি মানুষের কাছে পরিচিত আরো অনেক বৈশিষ্ট্যের জন্য। কখনো ইংল্যান্ডের রাজকীয় মুকুট, কুহিনুর, গয়না ও সম্পদের ভাণ্ডার, কখনো অস্ত্রাগার, কখনো কোষাগার, কখনো নথিপত্রের ভাণ্ডার, আবার- আরো অনেক ভূমিকাতে কাজে লাগানো হয়েছে এই ঐতিহাসিক ভবনটিকে।
আবার কারো কারো কাছে এটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত এর ভয়ংকর কয়েদখানা এবং নির্যাতন কক্ষের জন্য।
টাওয়ার অফ লন্ডন একটি মধ্যযুগীয় পুরানো দুর্গ। আমার দৃষ্টিতে এটি লন্ডনের আইকনিক ল্যান্ডমার্কগুলির মধ্যে অন্যতম। রক্তাক্ত ইতিহাসসহ সবচেয়ে ঐতিহাসিকগুলির একটি, যা প্রায় এক হাজার বছর আগের।
ইংল্যান্ডের লন্ডনের টাওয়ার ব্রীজের কাছাকাছি অবস্থিত এই দুর্গটির ঐতিহাসিক ভূমিকা অনেক। এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।
টাওয়ার অফ লন্ডন সম্পর্কে আমার এত জানা ছিলনা। টাওয়ার অব লন্ডন ঘুরে দেখার জন্য, জানার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন ইউকে বাংলা রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রেসিডেন্ট (২০২৩-২০২৪ খ্রি) গবেষক, সাংবাদিক অগ্রজ প্রতীম আনসার আহমেদ উল্লাহ ভাই। টিকিটও উনার নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ করে দিলেন। এটি আমাদের প্রতি তাহার মহান আন্তরিকতার বহি: প্রকাশ।
শুক্রবার (৩০ আগস্ট, ২০২৪) জুমার নামাজ শেষ করে আনসার ভাইর নেতৃত্বে ঘুরে দেখে আসলাম টাওয়ার অফ লন্ডনের অন্দর মহল। সঙ্গে ছিলেন কমিউনিটি এক্টিভিস্ট জামাল আহমদ খান, এসকেএম আশরাফুল হুদা, মির্জা আবুল কাসেম।
ঘুরে ঘুরে দেখলাম টাওয়ার অফ লন্ডনে ভিতরে বাইরে। অগ্রজ প্রতীম সাংবাদিক আনসার ভাই অনেক অজানা তথ্য জানালেন ইতিহাসের পটভূমি থেকে।
জানলাম এর প্রারম্ভিক ভিত্তি, ১০৬৬ সালে স্থাপিত হয়েছিল।
হোয়াইট টাওয়ার , সবচেয়ে ভিতরের ওয়ার্ডে অবস্থিত একটি কিপ, এটি দুর্গের প্রাচীনতম অংশ এবং ১০৭০ এর দশকে।
প্রত্যেকটা জিনিস নির্মাণের একটা কারণ থাকে, উদ্দেশ্য থাকে।
টাওয়ার অফ লন্ডন নির্মিত হওয়ার পেছনেও অনেক কারণ লুকায়িত রয়েছে।
আনসার ভাই সাথে আলাপকালে যা জানলাম তা তুলে ধরছি।
ইতিহাস থেকে জানা যায় – টাওয়ার অফ লন্ডনে প্রবেশ করার পর এক সময় দেখবেন ছোট করে লেখা আছে হোয়াইট টাওয়ারটি।
এই হোয়াইট টাওয়ারটি উইলিয়াম দ্য কনকারর দ্বারা লন্ডনে বসবাসকারী বিজিত স্যাক্সনদের তীব্র বিরোধিতার বিরুদ্ধে তার অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। কিপটি নরম্যান সামরিক শক্তির একটি শক্তিশালী এবং ভীতিজনক প্রক্ষেপণ হিসাবে কাজ করেছিল, যদিও স্থানীয়দের কাছে এটি নিপীড়নের একটি ক্ষুব্ধ প্রতীক ছিল বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি লন্ডন টাওয়ার নির্মাণ কাহিনী হল ১০৬৬ সালের দিকে।
১০৬৬ সালে ইংল্যান্ড বিজয়ের পর উইলিয়াম দ্য বিজেতা কর্তৃক লন্ডনের টাওয়ারে পরিণত হওয়ার প্রথম কাঠামোগুলি নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তী ২৫০ বছরে, দুর্গটি বিভিন্ন ইংরেজ রাজাদের অধীনে বেশ কয়েকটি সম্প্রসারণ পর্যায় অতিক্রম করে।
এবার শুনোন টাওয়ার অফ লন্ডন ব্যবহারের কারণ:
এ টাওয়ারটি তার দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে অনেক ভূমিকা পালনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে এবং পুনঃনির্ধারিত হয়েছে।
এর প্রাথমিক ইতিহাসে, এটি একটি বিশাল রাজকীয় প্রাসাদ ছিল।
পরবর্তীতে, এটি একটি দুর্গ এবং কারাগার, মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার একটি স্থান, একটি অস্ত্রাগার, একটি রাজকীয় টাকশাল এবং একটি মেনাজেরি (বা চিড়িয়াখানা) হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
এটি বর্তমানে ইংল্যান্ডের অমূল্য ক্রাউন জুয়েলসের আবাসস্থল।যেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে হলে অনেক সময় নিয়ে আসতে হবে।
এ টাওয়ার অফ লন্ডনে থাকেন ৩৭ জন ইয়োমান ওয়ার্ডারদের আবাসস্থল, বৃটিশ সামরিক বাহিনী থেকে আকৃষ্ট পুরুষ এবং মহিলাদের একটি দল যারা কমপক্ষে ২২ বছর সক্রিয় পরিষেবা রেকর্ড করতে হবে। ‘Beefeaters’ ডাকনাম, তারা টিউডর সময় থেকে টাওয়ার পাহারা দিচ্ছে।
এটি বিখ্যাত টাওয়ার রেভেনসের বাড়িও, যাদের প্রস্থান কিংবদন্তি অনুসারে, যদি তারা কখনও উড়ে যায় তবে ‘রাজ্যের পতন’ ঘোষণা করবে।
অনেকে জানার কৌতুহল থাকে এ টাওয়ার অফ লন্ডনের মালিক কে?
আসলে লন্ডনের টাওয়ারটি ক্রাউন এস্টেটের মালিকানাধীন, যা রাজকীয় রাজা হয়ে ‘মুকুটের অধিকারে’ মহামহিম দ্য কিং-এর অন্তর্গত। এটি মুকুটের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় এবং তাই বিক্রি করা যাবে না।
এই অসম্ভ ব্রিটিশ রাজকীয় দুর্লভ জিনিস ও ইতিহাসের অজানা কাহিনী শুনেন এবং সময় পেলে একবার এসে দেখে যান লন্ডনের টাওয়ারে দেখার অনেক কিছু আছে।
অবশ্যই দেখার হাইলাইটগুলির মধ্যে রয়েছে হোয়াইট টাওয়ার, জুয়েল হাউস, অমূল্য ক্রাউন জুয়েলসের বাড়ি, রয়্যাল মিন্ট, ‘ব্লাডি টাওয়ার’ এবং টাওয়ার গ্রিন, টাওয়ারে অনেক মৃত্যুদণ্ডের স্থান সহ আরো অনেককিছু।
প্রতি সন্ধ্যায় টাওয়ারের গেটগুলির ৭০০ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী ‘তালাবদ্ধ’ ‘সেরিমোনি অফ দ্য কী’ দেখার সুযোগও রয়েছে।
এভাবে দেখতে দেখতে আপনার অনুসন্ধানী গবেষক মন নিয়ে
লন্ডনের অন্যতম বিখ্যাত ল্যান্ডমার্কের দীর্ঘ, রক্তাক্ত ইতিহাস উন্মোচন করতে প্রায় ১০০০ বছর পিছিয়ে যান। কীভাবে একটি রাজকীয় বাসভবন কারাদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ডের একটি কুখ্যাত স্থান হয়ে উঠেছে তা আবিষ্কার করুন এবং অমূল্য ক্রাউন জুয়েলস সংগ্রহের কাছাকাছি যান।আমরা শেষের দিকে এসে অমূল্য ক্রাউনটি দেখেছিলাম, রাণীর মুকুট। যার অনেক ইতিকথা আছে।
রাণীর মুকুট বা কোহিনূর :
এই কোহিনূর বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত রত্নগুলোর একটি, যা ঔপনিবেশিক যুগে ভারত থেকে ব্রিটেনের হস্তগত হয়েছিল।
রানি এলিজাবেথের মায়ের জন্য বানানো মুকুটে ২ হাজার ৮০০ মূল্যবান পাথর বসানো হয়, যার মধ্যে একটি হল ১০৫ ক্যারেটের ডিম্বাকৃতির জ্বলজ্বলে সেই কোহিনূর হীরা।
পরে সেই মুকুটের অধিকারী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৭০ বছর ব্রিটেন শাসন করেন। ৯৬ বছর বয়সে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ , বৃহস্পতিবার তিনি মারা যান।
দ্বিতীয় এলিজাবেথ, পুরো নাম এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা ম্যারি; জন্ম: ২১ শে এপ্রিল ১৯২৬ — মৃত্যু ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২.।
তিনি ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের রানি ছিলেন। দীর্ঘসময়ের এই রাজত্ব রানীর মাথায় এই মুকুটটি শোভা পেত।
টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি তথ্য মতে , ১২-১৪ শতকের কাকাতিয়ান রাজবংশের সময় ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে খনন করে এটি পাওয়া গিয়েছিল এই কোহিনূরটি্ । তখন এটি পুরোটা ৭৯৩ ক্যারেট ছিল বলে মনে করা হয়।
১৬ শতকে প্রথমে এটি মুঘলদের হাতে আসে। তারপর পারস্য সম্রাট নাদির শাহ এটি লুট করে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে আফগানদের হাতে চলে যায় হীরাটি।
ভারতের শিখ মহারাজ রঞ্জিত সিং আফগান নেতা শাহ সুজা দুররানির কাছ থেকে এটি ভারতে ফিরিয়ে আনেন। তার থেকেই এটি যায় ব্রিটিশদের কাছে।
১৮৪০ এর দশকের শেষের দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১০ বছর বয়সী মহারাজা দুনজিপ সিংকে তার জমি ও সম্পত্তি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার পর রত্নটি দখল করে নেয়।
কোম্পানি তখন রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে হীরাটি উপস্থাপন করে। তার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট সেটি কেটে রানি আলেজান্ড্রা এবং রানি মেরির মুকুটে বসিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা রানি এলিজাবেথ বা কুইন মাদারের মুকুটে ১৯৩৭ সালে হীরাটি বসানো হয়।
কুইন মাদার ১৯৫৩ সালে তার মেয়ে দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় মুকুটের একটি অংশ পরেছিলেন। সে সময় থেকেই ব্রিটিশ রানির মুকুটে কোহিনূর হীরা রয়ে গেছে।
টাওয়ার অব লন্ডনে প্রবেশের আগে অন্যপাশ আছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের আত্মদানকারী বীরদের স্মৃতি ফলক। যেখানে সহস্র সহস্র নাম রয়েছে। ব্রিটিশ সহ নানা জাতি বর্ণের মানুষজন এ দুটি যুদ্ধে জীবন দিয়েছিলেন। এখানে বাঙালি বীরদের নামও রয়েছে। এরসংখ্যা সংখ্যাও কম নয়। আনসার ভাই জানালেন এদুটি যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে লড়াই করে নিহত হওয়া বাঙালি বীরদের সংখ্যা ১৫ থেকে ১৬ হাজার হবে। এনিয়ে অনেক অনুসন্ধান এ গবেষণার প্রযোজন।