সরদার হাসান ইলিয়াছ তানিম প্যারিস (ফ্রান্স) :
ফ্রান্সের পূর্ব সীমান্তবর্তী স্ট্রাসবুর্গ শহরটি ইউরোপের অন্যতম ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এটি রাইন নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এবং ফ্রান্স ও জার্মানির ঐতিহাসিক সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় দুই দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের প্রতীক।
স্ট্রাসবুর্গ শুধুমাত্র তার মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য ও প্রাণবন্ত সংস্কৃতির জন্য নয়, সাংবাদিকতার আধুনিক ইতিহাসে তার অনন্য অবদানের জন্যও বিশ্ববিখ্যাত।
স্ট্রাসবুর্গের ঐতিহাসিক:
ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন: স্ট্রাসবুর্গের ইতিহাস হাজার বছরের বেশি পুরনো, যার শুরু রোমান সাম্রাজ্যের সময়। পরবর্তীতে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে হাবসবার্গ এবং পরবর্তীকালে জার্মান ও ফরাসি শাসনের অধীনে এই শহর বিকশিত হয়েছে। ফরাসি ও জার্মান সংস্কৃতির মিশ্রণে শহরটির ভাষা, খাদ্য, উৎসব, স্থাপত্য এবং সামাজিক জীবন অনেকটাই গঠন পেয়েছে।
মধ্যযুগে স্ট্রাসবুর্গ ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও বন্দর নগরী হিসেবে আবির্ভূত হয়। রাইন নদীর মাধ্যমে এর বাণিজ্য বর্ধিত হওয়ার ফলে শহরটি দ্রুত বিকশিত হয় এবং বিভিন্ন জাতির বণিক ও কারিগরদের মিলনস্থল হয়। ইউরোপীয় ঐক্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে স্ট্রাসবুর্গের ভূমিকা যুগে যুগে বিশেষত উল্কিপথের মতো গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিক স্থাপনা ও স্থলসমূহ: স্ট্রাসবুর্গের স্থাপত্যশৈলী এবং ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন শহরের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। শহরের প্রাণকেন্দ্র হলো স্ট্রাসবুর্গ ক্যাথেড্রাল (Cathédrale Notre-Dame de Strasbourg), যা ১৩১ মিটার উচ্চতা নিয়ে দীর্ঘদিন বিশ্বের সর্বোচ্চ মানবসৃষ্ট ভবন ছিল। গথিক স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন, এর সূক্ষ্ম কারুকাজ, কাঁচের জানালা এবং বিশেষ সূর্যঘড়ি পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
পেটিট ফ্রান্স এলাকা শহরের সবচেয়ে চমৎকার ও মনোরম অংশ, যেখানে মধ্যযুগীয় কাঠের বাড়িগুলো জলপ্রপাত ও জলধারার পাশে অবস্থিত। এই এলাকা শহরের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সরাসরি দৃষ্টান্ত।
প্যালাস রোহান (Palais Rohan) প্রাসাদটি ১৭শ শতাব্দীতে নির্মিত, যা বর্তমানে আর্ট মিউজিয়াম ও ঐতিহাসিক প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়া শহরে রয়েছে সেন্ট থমাস চার্চ, প্রাচীন দুর্গ ও জনরক্ষা দেয়াল, যা শহরের সামরিক ও ধর্মীয় ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে। স্ট্রাসবুর্গের ঐতিহাসিক শহরতলি ইউরোপীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণের এক অনন্য উদাহরণ, যা ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য স্থল হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।
বিশ্ব সাংবাদিকতার জন্মভূমি হিসেবে স্ট্রাসবুর্গ: ১৬০৫ সালে জোহান কারোলাস সম্পাদিত তৎকালীন রোমান সাম্রাজ্য জার্মানির স্ট্রাসবুর্গ (বর্তমানে ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত) শহর থেকে জার্মান ভাষায় Relation aller Fürnemmen und gedenckwürdigen Historien বা ‘সর্বশ্রেষ্ট ও স্মরণীয় ঘটনার প্রতিবেদন’ শীর্ষক শিরোনামে বিশ্বের প্রথম নিয়মিত সংবাদপত্র প্রকাশ করা হয়। এই পত্রিকাটি আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃত হিসেবে বিবেচিত।
এটি ছিল খবরভিত্তিক এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রকাশিত — যা একটি আধুনিক সংবাদপত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। একইসাথে এটি আধুনিক সাংবাদিকতার ভিত্তিপ্রস্তর, যা সংবাদপ্রচারে পেশাদারিত্বের বৈচিত্র্য নিয়ে আসে।
এই সংবাদপত্র সাধারণ মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছানোর এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয় এবং তথ্যের মুক্ত প্রবাহের পথ প্রশস্ত করে। স্ট্রাসবুর্গের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের ইতিহাসে এক অমলিন ছাপ রেখেছে, যা আজকের তথ্যপ্রযুক্তি যুগেও প্রাসঙ্গিক। যার প্রেক্ষিতে স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ব সাংবাদিকতার ইতিহাসে ঐতিহাসিক শহর হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করছে।
রাইন নদী ও স্ট্রাসবুর্গের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব: রাইন নদী ইউরোপের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা সুইজারল্যান্ড থেকে শুরু হয়ে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। স্ট্রাসবুর্গ নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত, যার কারণে এটি নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব বহন করে। রাইন নদীর কূলে অবস্থিত হওয়ায় স্ট্রাসবুর্গ ইউরোপীয় বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগের অন্যতম কেন্দ্র। নদী শহরটিকে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধনের রূপ দিয়েছে, যা ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে। আজও স্ট্রাসবুর্গের নদীতীর অঞ্চল তার বন্দর, জলপথ ও পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ।
স্ট্রাসবুর্গের ইতিহাস, স্থাপত্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং সাংবাদিকতার প্রথম যাত্রা এই শহরকে ইউরোপের এক অনন্য রত্নে পরিণত করেছে। রাইন নদীর তীরে অবস্থিত এই শহর সত্য ও তথ্যের আলোর দিশারি হয়ে বিশ্ব সংবাদ ইতিহাসে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। যুগ যুগ ধরে ফরাসি ও জার্মান প্রভাবের মিলনে গড়ে ওঠা এই শহরটি শুধু ঐতিহাসিক নয়, আধুনিক ইউরোপের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত। স্ট্রাসবুর্গের ঐতিহ্য, সৌন্দর্য ও সাংবাদিকতার কীর্তি আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।