ঋষি সুনাক: স্বপ্ন, সংগ্রাম আর বিদায়ের গল্প
আ স ম মাসুম :
অতিথি লেখক,
জগন্নাথপুর টাইমস ঃ
হিথ্রো বিমানবন্দরে নামার ঠিক আগেই জানালার বাইরে তাকিয়ে ঋষি সুনাক ভাবছিলেন—এই লন্ডন শহরই তো তাঁর স্বপ্ন গড়ার মাটির শহর, আবার আজ এখানেই যেন সেই স্বপ্নের শেষ পর্ব।
ঋষি সুনাকের জন্ম ১৯৮০ সালে, সাউথ্যাম্পটনের এক অভিবাসী পরিবারে। পিতামাতা ছিলেন চিকিৎসক আর ফার্মাসিস্ট। ছেলেবেলা থেকেই ঋষি সুনাকের চোখে ছিল বড় কিছু করার স্বপ্ন। অক্সফোর্ডে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা, পরে স্ট্যানফোর্ডে এমবিএ—সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন অসাধারণ।
কিন্তু, কেবল সাফল্যের খাতা পূরণ করাই ছিল না তাঁর লক্ষ্য।
তিনি চেয়েছিলেন পরিবর্তন আনতে।
রাজনীতিতে তাঁর উত্থান ছিল রীতিমতো সিনেমার গল্পের মতো। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে চ্যান্সেলর হলেন। তারপর ২০২২সালে, যখন ব্রিটেন এক রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত, তখন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হিসেবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ঋষি সুনাক।
তাঁর প্রথম দিনগুলো ছিল ঘূর্ণিঝড়ের মতো—ইউক্রেন যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, এনএইচএস সংকট, এবং অভিবাসন ইস্যু। কঠোর সিদ্ধান্ত, নির্বিচারে পরিশ্রম আর প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান—এই তিনে ভর করে তিনি এগোতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু রাজনীতির মঞ্চে শুধু যুক্তি নয়, আবেগও চলে।
লোকেরা ধীরে ধীরে প্রশ্ন করতে শুরু করে—এই রোবটের মতো প্রধানমন্ত্রীর আদৌ কি সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট বোঝার ক্ষমতা আছে?
তাঁর ধনাঢ্য শ্বশুর-ঘর, বিলিয়ন পাউন্ডের পেছনের জীবন ধীরে ধীরে তাঁকে দূরে ঠেলে দেয় সাধারণ জনগণের হৃদয় থেকে।
এমনকি তাঁর স্ত্রী অক্ষতা মূর্তির ট্যাক্স বিষয়ক বিতর্ক তাঁকে বড় ধাক্কা দেয়।
নির্বাচনের দিন। টেলিভিশনের পর্দায় ফলাফল একে একে আসছে। কনজারভেটিভ পার্টি ধসে পড়ছে।
এক সময় ঋষি সুনাক চুপচাপ উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ান। বাইরে বৃষ্টির শব্দ।
হাতের কাপে ধোঁয়া উঠছে, আর মনের মধ্যে ভেঙে পড়ছে এক সময়ের দৃঢ় স্বপ্ন।
তিনি জানেন, সময় এসেছে সরে যাওয়ার।
কিন্তু সরে যাওয়া মানে পরাজয় নয়—এটা এক পর্বের ইতি।
তিনি চুপচাপ লিখতে শুরু করেন পদত্যাগপত্র। হাতে কাঁপন নেই, চোখে জল নেই—শুধু এক গভীর নিঃশ্বাস।
“আমি চেষ্টা করেছি। কখনো নিখুঁত হইনি, কিন্তু সবসময় দেশের ভালোটাই ভেবেছি। এখন নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন।”
সাংবাদিকরা ক্যামেরা তাক করে আছে, ভিড় জমেছে ডাউনিং স্ট্রিটে। ঋষি সুনাক বেরিয়ে আসেন, কালো কোট, মৃদু হাসি—শেষবারের মতো জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেন।
তাঁর কণ্ঠে কোনো হতাশা নেই।
তিনি বলেন, “আমি ব্রিটেনকে ভালোবেসেছি হৃদয়ের গভীর থেকে। আজ নয়, আগামীর জন্য হয়তো কেউ বুঝবে—আমি কেন লড়েছিলাম।”
অভিবাসী বাবা-মায়ের সেই ছেলে হয়তো হেরে গেল এক ভোটযুদ্ধে, কিন্তু সে ইতিহাসে থাকবে—ব্রিটেনের প্রথম এশীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে,
এক সাহসী স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে। যার বিদায়ও এক প্রেরণার গল্প।