একটি কবিতা ও আমার শিক্ষাগুরুর স্মৃতি –
অজয় কুমার দাশ মহালদার
::::
আজ এমন একটি মহোত্তম স্মৃতির রোমন্থন করছি এবং যার সম্পর্কে কিছু কথা লিখছি, তিনি আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মহার্ঘ্য শিক্ষা টি দিয়েছিলেন। যে শিক্ষা টি আমি আজও সযতনে লালন করছি ও পালন করে যাচ্ছি। আমার জন্ম, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে।আমাদের গ্রামটি শুধু প্রত্যন্তই ছিলো না, রাস্তা ঘাট তথা যোগাযোগ ব্যাবস্থা ও ছিল অত্যন্ত নাজুক। শিক্ষা দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। আমাদের পাশাপাশি দুটি গ্রাম জগ্ননাথপুর ও সোনাপুর মিলে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা পাঠশালা ছিলো। পাঠশালায় তিন জন নিবেদিত প্রাণ মাস্টার মহাশয় আমাদের পড়াতেন।শুধু পড়াতেন বললে ভুল হবে মুলত তাঁরা ছিলেন সত্যিকার অর্থে আমাদের Friend, Philosopher & Guide। তাঁদের নির্দেশিত ও দেখানো পথে চলে অনেকেই সামনের দিকে সঠিক ভাবে এগিয়ে যেতে পেরেছেন, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।
কদিন আগে আমার বন্ধুবর শিশির হালদার বাবু তাঁর টাইম লাইনে বেশ কয়েকটি কবিতা পোস্ট করেছিলেন। কবিতা গুলো একটার পর একটা পড়ছিলাম খুব মনোযোগ দিয়ে, হঠাৎ একটি কবিতায় আমার দৃষ্টি থেমে যায়। আমার শরীর রোমাঞ্চিত হয়,আমাকে স্মৃতি কাতর করে তুলে। প্রায় ৫০ বছর পুর্বে আমি যখন ৪র্থ বা ৫ ম শ্রেনিতে পড়তাম তখনকার একটা সুখময় মুহুর্তের স্মৃতি আমার মনে পড়ে যায়।
যা এ মুহুর্তে আমি রোমন্থন করছি। আমাদের পাঠশালার যিনি প্রধান ছিলেন যাকে আমরা বড় মাস্টাবু ( বড় মাস্টার বাবু) বলতাম অধুনা যাকে প্রধান শিক্ষক মহোদয় বা হেডমাস্টার স্যার বা হেড স্যার বলে সম্বোধন করা হয়। বড় মাস্টাবু ছাড়া ও অন্য যে দুজন শিক্ষক ছিলেন উনারা হলেন শ্রী মহেন্দ্র চন্দ্র দাশ এবং শ্রী মনীন্দ্র কুমার চৌধুরী। এ দুজন শিক্ষক ও ছিলেন নিবেদিত প্রাণ ও ছাত্রদের অত্যন্ত আপন জন । তারাও আজ আমাদের মধ্যে নেই। উনাদের পূণ্য স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণতি জানাই।
বড় মাস্টাবু শ্রী সুরেশ চন্দ্র রায় মহাশয় আমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মহার্ঘ্য শিক্ষা দিয়েছিলেন যা আমার জীবন কে অনেক টা পাল্টে দিয়েছে।সেই ঋণ স্বীকার ও কৃতজ্ঞতা, বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানানো এবং পুণ্য স্মৃতি তর্পণের জন্যই আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
বড় মাস্টাবু আমাদের দুই প্রজন্মের কোন কোন ক্ষেত্রে তিন প্রজন্ম কে শিক্ষা দিয়েছিলেন, পড়িয়েছিলেন, অনেকের আজ্ঞান অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলোক শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছেন। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে নিবেদিত প্রাণ ও আদর্শ শিক্ষক তথা মানুষ গড়ার কারিগর। সত্যিকার অর্থে মাস্টার মহাশয় বা শিক্ষাগুরু বলতে যা বুঝায় তা ই ছিলেন ঋষিতুল্য আমার বড় মাস্টাবু শ্রী সুরেশ চন্দ্র রায় মহাশয়। তিনি বিদ্যালয়ে পড়ানোর,পাঠদানের পাশাপাশি ছাত্র ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খবর নিতেন, খোজ নিতেন।তারা সুস্থ আছে কি না? ঠিক মতো পড়াশোনা করছে কিনা?কারো কোনো সমস্যা আছে কি না? এর জন্য তিনি ছুটির দিন সারাক্ষণ এবং বিদ্যালয় খোলার দিন বিকেল বেলা দুই গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বেড়াতেন এবং ছাত্র ছাত্রীদের খোঁজ খবর নিতেন।
কোন এক ছুটির দিনে তিনি আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন,এ সময়ে কাকতালীয়ভাবে আমি ঘর থেকে বাহির হয়ে উনার সামনে পড়ে যাই কিন্তু বড় মাস্টাবু কে দেখে দৌড়ে পালিয়ে যাই।বড় মাস্টাবু আমাকে কিছু না বলে পাড়ার অন্যান্য বাড়ির দিকে এগিয়ে যান।সমস্ত পাড়া ঘুরেফিরে ছাত্র ছাত্রীদের খোঁজ খবর নিয়ে আমাদের বাড়িতে আবার ফিরে এসে আমার বাবার নাম ধরে ডাকেন এবং আমাকে ডেকে দিতে বলেন ।যথারীতি আমার বাবা আমাকে ডেকে দিলেন।আমি আসার পরে আমার হাত ধরে তিনি আমাদের বসার ঘরে নিয়ে গেলেন এবং বাবাকে সরে যেতে বললেন। বড় মাস্টাবু যখন আমার হাত ধরলেন তখন আমার মনে হল আজ আমি আর আস্ত থাকবো না, না জানি কি অপরাধ করেছি।কিন্তু তেমনটা কিছুই হলো না। বসার ঘরে প্রবেশ করে একটি চেয়ার এ বসে তিনি পরম যতনে ও মমতায় আমার হাতটি ধরে রেখে ভরাট ও মধু মাখানো কন্ঠে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ এর বিখ্যাত ” শিক্ষাগুরুর মর্যাদা ‘ কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনালেন। আমি বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে মন্ত্র মুগ্ধের মতো কবিতা টি শুনতে লাগলাম।
কবিতার কয়েকটি লাইন
বাদশাহ আলমগীর
কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া —–
উল্লাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায় সগৌরবে
কুর্নিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে—
” আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষা গুরুর শির
সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর। ”
কবিতা আবৃত্তি শেষ করে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কিছু বুঝেছি কি না? আমি মাথা নিচু করে কাচু মাচু হয়ে বললাম বুঝেছি।তিনি বললেন কি বুঝেছিস? (কবিতা বা কবিতার মর্মার্থ কিছুই বুঝিনি শুধু নিজের অপরাধ টুকুই বুঝেছিলাম)বললাম আমি তখন আপনাকে ভক্তি না দিয়ে , নমস্কার না করে পালিয়ে গিয়েছিলাম, যা ঠিক হয়নি।তিনি স্মিত হেসে খুব আদর করে,সস্নেহে, পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” জীবনে কোনদিন তা করবে না, শিক্ষক ও গুরুজন কে সদা সর্বদা শ্রদ্ধা করবে, ভক্তি করবে।কোন দিন এর ব্যাতিক্রম করবে না”।
এ শিক্ষা আমি কোনদিন ভুলি নাই।ছাত্র জীবনে পাঠশালা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যখন যেখানে আমার কোন শিক্ষকের সাথে দেখা হয়েছে আগে উনাকে ভক্তি,সালাম দিয়েছি পরে কুশল বিনিময় করেছি।চাকুরি কালীন সময়ে কর্মস্থলে আমার শিক্ষকবৃন্দের সাথে দেখা হলেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি।এ শিক্ষা অন্তরে লালন করেছি, অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি এবং আজও করে যাচ্ছি।
ভাবতে অবাক লাগে মাস্টার মহাশয় কি অভিনব পন্থায় আমাকে সৌজন্য, সহবত ও শিষ্টাচারের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি ইচ্ছে করলে আমাকে ধমকাতে পারতেন,শাসন করতে পারতেন,চাই কি পিঠে দু ঘা লাগিয়ে দিতে পারতেন, যা সচরাচর হয়ে থাকে, কিন্তু তিনি তা না করে অভূতপূর্ব ভাবে ,অনন্য,অনবদ্য ও অনুকরনীয় পন্থায় কত সহজে আমাকে শিক্ষা দিলেন। শৈশব ও কৈশোরের ডানপিটে ও দুরন্ত এক অবাধ্য ছেলেকে সৌজন্য, সহবত ও শিষ্টাচারের যে পাঠ তিনি দিয়েছিলেন, তা আমার অন্তরে সদাসর্বদা বিরাজমান, অমলিন ও অমর হয়ে আছে,আমার স্মৃতিতে অক্ষয় ও ভাস্বর হয়ে আছে এবং থাকবে।
সত্যিই একটা কবিতা কত শক্তিশালী ও অবিনাশী প্রভাব বিস্তারকারী হতে পারে এবং প্রকৃত ও সফল শিক্ষাগুরুর শিক্ষা কত স্বার্থক ও কার্যকরী হতে পারে,ফলপ্রসূ হতে পারে, কত দুরন্ত ডানপিটে ছেলেকে সৌজন্য সহবত শিখাতে পারে,অনেক পথ হারাকে সঠিক পথের দিশা দেখাতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে আমার বড় মাস্টাবুর শিক্ষা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং ” শিক্ষকের মর্যাদা” কবিতা টি।বড় মাস্টাবুর শিক্ষা যেন সহস্রদলের পদ্মের কুড়ি যা ধীরে ধীরে মুকলিত হয়ে দিকে দিকে সৌরভ ছড়াচ্ছে।
আমার বড় মাস্টাবু অনেক অনেক আগেই স্বর্গবাসী হয়েছেন কিন্তু তাঁর দরাজ কন্ঠে উচ্চারিত কবিতা ও অমৃতময় উপদেশবাণী আমার কর্ণকুহরে আজও প্রতিনিয়ত ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয়।সত্যিই আমি কত ভাগ্যবান যে এরকম একজন প্রাতস্মরনীয়, প্রতিতযশা,
ঋষিতুল্য মহান শিক্ষাগুরুর পদ প্রান্তে বসে আমি আমার জীবনের প্রথম পাঠ নিতে পেরেছিলাম।
আমার বড় মাস্টাবু শ্রী সুরেশ চন্দ্র রায় মহাশয় ইহ জগতে না থাকলেও তিনি সততই আমার হৃদয়ে, মননে, অস্তিত্বে, অনুভবে অবিনশ্বর, চির জাগরুক, অম্লান ও অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
জয়তু বড় মাস্টাবু, বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম।