লন্ডনে বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং আমাদের স্বপ্ন
– আনোয়ার শাহজাহান
::
প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের লন্ডন অন্যতম, যেখানে কয়েক প্রজন্মের বাংলাদেশি রয়েছেন শতাব্দীকালবাপী। গতিময় প্রবাসজীবনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও আমাদের নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষার চর্চা থেকে অনেকটাই বিচ্যুত। যেহেতু আমাদের নতুন প্রজন্ম একসময় প্রবাসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে, তাই বাংলাদেশি-অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনে নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকে। আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু হবে।
বাংলা স্কুলে ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সের যেকোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে। লন্ডনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে বাংলা স্কুলে শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষা দেয়া হবে। স্কুল পরিচালনায় যাবতীয় খরচ বহন করবে গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকে।
প্রাথমিকভাবে প্রতি সপ্তাহের শনিবার স্কুলের কার্যক্রম চলবে পূর্ব লন্ডনের দ্য চিলড্রেন এডুকেশন সেন্টারে। প্রবাসে বেড়ে ওঠা তৃতীয় প্রজন্মের কাছে শুধু বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরাই নয়, একটি বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে আমরা মনে করি।
প্রবাসে আমাদের সন্তানরা বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি জানবে GUST Bangla School-এর মাধ্যমে। এটা অবশ্যই আনন্দের বিষয়। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন কোনোভাবেই নিজের শেকড়কে ভুলে না যায়; আমাদের শিশুরা যেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি হৃদয়ে লালন করে। কেননা বিদেশি ভাষায় পড়ালেখার কারণে শিশুদের বাংলা ভাষা শেখার সুযোগ তেমন হয়ে ওঠে না। একটি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জানার অন্যতম মাধ্যমই হচ্ছে তার ভাষা। তাই বাংলাদেশকে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে তাদের বাংলা ভাষা শেখানোর বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে আমাদের।
উল্লেখ্য, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি তথা বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বহমান রাখতে গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে গোলাপগঞ্জ উৎসব, পিঠামেলা, কেরাত প্রতিযোগিতা, ফুটবল টুর্নামেন্ট, প্যারেন্টস কনফারেন্সসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য সংগঠনটি ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে যথেষ্ট আস্থা অর্জন করেছে।
এসব অনুষ্ঠানে আমাদের নতুন প্রজন্ম কতটুকু স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে, তা দেখার প্রয়োজন আছে। যদি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে তাদের পরিচয় না থাকে এবং একটি শব্দও বাংলায় বলতে না পারে, তাহলে তাদের কাছে এসব মেলা, উৎসব ও দিবস উদযাপন বিরক্তিকর বিষয় ছাড়া আর কিছুই হবে না। অনেকে নতুন প্রজন্মের জন্য বিভিন্ন দিবসে অংশগ্রহণমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, বিশেষ করে বাংলা ভাষাচর্চা-বিষয়ক। এতে কিছু কিছু পরিবারের সন্তানেরা অভাবনীয় সাফল্য প্রদর্শন করলেও বেশির ভাগই দেখা যায় শুধু মঞ্চে ওঠা এবং পরের দিন তা পত্রিকার পাতায় খবর ও ছবি ছাপানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
প্রবাসে বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরার জন্য আমাদের শিশুদের জন্য নানা ধরনের অনুষ্ঠান করে থাকি, কিন্তু এসব আয়োজন মূলত কাদের জন্য? আমাদের মধ্যবয়সী আর প্রবীণদের পদচারণে মুখর থাকে অনুষ্ঠানগুলো। এসব অনুষ্ঠানে আসতে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ খুবই কম, এমনকি নেই বললেই চলে। ওরা যেহেতু বাংলা ভাষায় কথাই বলতে পারে না, তাই তাদের আমরা বাংলা সংস্কৃতির কতটুকু ধারণাই-বা দিতে পারব?
লন্ডনে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবছর বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে প্রবাসে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে মহৎ। কিন্তু এ বই কারা কেনে, নিশ্চয়ই আমাদের সন্তানরা নয়? বাংলা ভাষার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন, তাঁদের সম্মানে একুশের প্রথম প্রহরে শোভাযাত্রা এবং শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ দেয়া হয়, সেখানেও আমাদের সন্তানরা অনুপস্থিত। পিঠামেলা, বৈশাখী মেলা কোথাও নেই এ দেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে আগামী ৫০ বা ১০০ বছর পর প্রবাসে কি আমাদের বাংলা ভাষা সগৌরবে টিকে থাকবে?
সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য কর্তৃক আয়োজিত বাংলাদেশ বইমেলা এখন লন্ডনে বৃহত্তম সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। দেশীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে এই মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে আমাদের নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সন্ধান দিতে নানা রকম অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
প্রতিবছর মহান ভাষা দিবস উদ্যাপনের সময় আলতাব আলী পার্কে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এলে আমরা অনেক আবেগমিশ্রিত কথা বলি, কিন্তু পরের দিন ঠিকই সবকিছু ভুলে যাই। আসুন, আবেগতাড়িত হয়ে যেসব কথা বলি, সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করি। সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের সন্তানরা দুই পরিবেশে বড় হচ্ছে। ঘর থেকে বেরোলেই তাদের সামনে আলাদা জগৎ। আমাদের কাজ হবে এ দুই ভুবনের মাঝে সুন্দর এক সেতুবন্ধ রচনা করা, যাতে করে সে অনায়াসে নিজের দেশ ও প্রবাসের সংস্কৃতি সমভাবে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। কোনোভাবেই যেন নিজের দেশের সংস্কৃতিচর্চাকে আরোপিত মনে না করে; দুই ভুবনে তাদের বিচরণ যেন হয় স্বতঃস্ফ‚র্ত। সবাই যদি প্রতিজ্ঞা করি, আমরা সন্তানদের সাথে বাসায় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলব, ঘরের পরিবেশ হবে পুরোপুরি বাংলাদেশি, ঘরটাকে বানিয়ে ফেলব একখণ্ড বাংলাদেশ এবং সেই সাথে সন্তানদের প্রচুর সময় দেব, তবেই আমাদের এসব মেলা, উৎসব উদ্যাপন ও সাহিত্যচর্চা সার্থক হবে।
এগিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। তাই আগামী দিনের সব চ্যালেঞ্জ ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় সেটা অবশ্যই সম্ভব। বিবর্তনের গড্ডলিকা প্রবাহে বাঙালি হিসেবে আমাদের অহংকারের জায়গা থেকে নতুন প্রজন্মকে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমাদের চ্যালেঞ্জ, আমাদের ভাষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার এবং পরবর্তী প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি তাদের মধ্যে স্বদেশ-স্বজন ভাবনাচিন্তা জাগ্রত করাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের সুযোগ তৈরি করা। আমাদের জন্মভিটা প্রিয় বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে প্রবাসের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে শেকড়সমৃদ্ধ মনন-মেধায় প্রজ্বলিত করার ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। পূর্বপুরুষদের গৌরবসমৃদ্ধ শেকড় থেকে তারা যেন কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে।
আসুন, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সফল করে তুলি লন্ডনে বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠার মহতী উদ্যোগকে। সেই সাথে সবার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করে মাতৃভাষা বাংলাতেও সুদক্ষ করে গড়ে তুলি, যাতে ভবিষ্যতে তারা প্রবাসে বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রযাত্রা সমুন্নত রাখতে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সচেষ্ট থাকে। হৃদয়ে ধারণ করতে পারে রক্তঝরা ইতিহাসের মাধ্যমে অর্জিত একটি নাম ‘বাংলাদেশ’।
আনোয়ার শাহজাহান
চেয়ারম্যান, লন্ডন বাংলা স্কুল।
GUST Bangla School, London – A Project of Golapganj Upazila Social Trust UK.
Anwar Shahjahan #londonbanglaschool #লন্ডন_বাংলা_স্কুল #london_bangla_school