জগন্নাথপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক:
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা থেকে ঘুষ-দুর্নীতির দায়ে প্রায় ৭ মাস আগে শাস্তিমুলক বদলি হওয়া বহুল আলোচিত-সমালোচিত সেই প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোতাহার বিল্লাহকে গত ১৫ নভেম্বর বড়লেখায় পদায়ন করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তদন্তে প্রমাণীত দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার বড়লেখায় যোগদানে বিভিন্ন মহলে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ চলছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সাবেক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোতাহার বিল্লাহর বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি যুগান্তরে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যুগান্তরের প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ১২ ফেব্রুয়ারি তার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন জমা দিলে গত ২৩ মার্চ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন-১) আব্দুল আলীম স্বাক্ষরিত আদেশে মৌলভীবাজার সদর থেকে তাকে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় বদলি করা হয়। এই বদলি আদেশে গত এপ্রিল মাসে তিনি মৌলভীবাজার ছাড়েন।
জানা গেছে, মৌলভীবাজার সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোতাহার বিল্লাহর ঘুষ বাণিজ্যে ভেঁঙ্গে পড়ে উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে ঘুষ গ্রহণই যেন ছিল তার মুখ্য কাজ। হয়রানির ভয়ে শিক্ষকরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেননি। তবে শতাধিক শিক্ষক তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন।
অভিযোগকারী শিক্ষকরা জানান, ফান্ড, ক্ষুদ্র মেরামত ও রুটিন মেইনটেন্যান্সের বরাদ্দ থেকে কমিশন দিতে হয় ওই কর্মকর্তাকে। বিদ্যালয় পরিদর্শন, মাতৃত্বকালীন ছুটি, বিদেশগমন এবং লোনের প্রত্যয়নেও ঘুষ নিতেন মোহাম্মদ মোতাহার বিল্লাহ। ঘুষ গ্রহণ তার কাছে অপেন সিক্রেট ব্যাপারে দাঁড়ায়। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষকদের সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার কথা। সকাল ৯টায় পরিদর্শনের নামে যেকোন বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতেন ওই কর্মকর্তা। এসময় কোন শিক্ষককে না পেলে বিকেলে দেখা করতে বলে দ্রæত চলে যেতেন। বিকেলে উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়ে দেরিতে আসা শিক্ষক কিংবা ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক টাকা দিয়ে ছাড় পেতেন। শিক্ষার মনোন্নয়নে নয়, শিক্ষকদের কাছ থেকে উৎকোচ আদায় করতেই তিনি বিদ্যালয় পরির্দশণ করতেন।
টাকা দেয়ার কথা স্বীকার করে নাম গোপন রাখার শর্তে এক সহকারী শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ে আসতে তার ২ মিনিট দেরি হয়। একজন ম্যাডামের ৩০ মিনিট দেরি হয়। এসময় টিও স্যার বিদ্যালয়ে গিয়ে আমাদের না পেয়ে বিকেলে অফিসে দেখা করার কথা বলে চলে যান। পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষিকা দেখা করে ২ হাজার টাকা দেন। নাম গোপন রাখার শর্তে একজন দপ্তরি বলেন, ৫ মাস আগে জনতা ব্যাংক মৌলভীবাজার আঞ্চলিক শাখা থেকে আড়াই লাখ টাকা ঋণ নেয়ার সময় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের একটি কাগজের জন্য ৫’শ টাকা দিতে হয়েছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে এক সহকারী শিক্ষক বলেন, বেতন ভাতা বিবরণী থেকে শুরু করে অফিসের প্রত্যেকটি কাজে ঘুষ দিতে হয়। আমার বেতন ভাতা বিবরণী আনতে টাকা দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, পরিদর্শনের নামে প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করেছেন ওই কর্মকর্তা। এক প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমার বিদ্যালয় থেকে সহকারী শিক্ষক শরীফ উদ্দিনের মাধ্যমে পি ফান্ড হতে টিও অফিস ৩ হাজার টাকা নিয়েছে। এভাবে প্রত্যেক বিদ্যালয় থেকে টাকা নেয়া হয়। এদিকে উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে দাওয়াত দেয়া হয় ওই কর্মকর্তাকে। বিদ্যালয়ে খাওয়া দাওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু শিক্ষা কর্মকর্তাকে উপঢৌকন না দেয়ায় তিনি রেগে যান। পরবর্তীতে ওই শিক্ষক অফিসে গিয়ে নগদ টাকা দিয়ে তাকে শান্ত করেন।
বড়লেখার কয়েকজন সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষক নেতা জানান, এই শিক্ষা কর্মকর্তা মৌলভীবাজার সদরে থাককালিন রীতিমতো ঘুস বাণিজ্য করেছেন। বিদ্যালয় পরিদর্শনের নামে প্রকাশ্যে শিক্ষকদের কাছ থেকে উৎকোচ নিতেন। পি ফান্ড, ক্ষুদ্র মেরামত ও রুটিন মেইনটেন্যান্সের বরাদ্দ থেকেও শিক্ষা কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে হয়েছে। যা একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়। তদন্তে প্রমাণীত হওয়ায় তাকে শাস্তিমুলক বদলিও করা হয়। বড়লেখা উপজেলাটি বর্তমান সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন এমপির এলাকা। দীর্ঘদিন এই উপজেলায় উপজেলা শিক্ষা অফিসারের পদ শূন্য ছিল। এই শিক্ষা অফিসারকে পদায়নে সংশ্লিষ্ট মহলে খুশির চেয়ে উদ্বেগ আতংক বিরাজ করছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এখানে এমন একজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করেছে যিনি মাত্র কিছু দিন আগে এই জেলারই একটি উপজেলা থেকে ঘুস-দুর্নীতির দায়ে বদলি হন। যা সবাই জানেন।
মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. খোরশেদ আলম জানান, অধিদপ্তর তাকে বড়লেখায় বদলি করেছে। ১৫ নভেম্বর তিনি (মোহাম্মদ মোতাহার বিল্লাহ) নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। অধিদপ্তর তার আমল নামার সবই জানে। এক্ষেত্রে তার কিছু করার নেই।