- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তাঁর অবিস্মরণীয় মানব দর্শন-
অধ্যাপক ম. আমিনুল হক চুন্নু
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের নায়ক; আমাদের আইকন। জীবদ্দশায় কাটিয়ে গেলেন কাউকে তোয়াক্কা না করে। পুরোজীবন ব্যয় করলেন দেশের অসহায় মানুষের তরে। সৎ, নির্লোভ, নির্ভীক এই মহান মানুষ ৮১ বছর অবধি তরুণদের মতো জীবনযাপন করেন। পুরো জীবদ্দশায় নিজেকে সার্থক ও পরিপূর্ণ করেছেন। অনুকরণীয়, অনুসরণীয় মানুষটির জীবনের কাহিনী মিথকেও হার মানায়। সামগ্রিক দিক মিলিয়ে বলা যায়, তাঁর জীবন বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময়।
ডা. চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলায়। পিতামাতার ১০ ছেলে-মেয়ের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ।
শিক্ষাজীবনে ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে এফআরসিএস পড়তে যান লন্ডনে। তখন তাঁর জীবন ছিল রাজকীয়। প্রাইভেট জেট চালানোর লাইসেন্স ছিল। দামি স্যুট, টাই, শার্ট, জুতা পড়তেন। ৪ বছরের এফআরসিএস কোর্স শেষের দিকে প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সপ্তাহখানেক পরেই ফাইনাল পরীক্ষা; এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। একজন সাধারণ চিন্তার মানুষ তখন কী করবেন? পরীক্ষা দিবেন, না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে নেমে যাবেন? উত্তর হওয়ার কথা, পরীক্ষা । তবে আমরা যাঁকে নিয়ে কথা বলছি, তিনি সাধারণ চিন্তার মানুষ ছিলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পরীক্ষা দিবেন না। সুদূর লন্ডন থেকে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে নেমে পড়লেন। এমনই মানুষ ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
জাফরুল্লাহ সেই ব্যতিক্রমধর্মী মানুষের একজন- যিনি তাঁর নিজের আয়ুরেখা নিজেই নির্মাণ করেছেন যাপিত জীবনের নানান অনুষঙ্গ দিয়ে। বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্মদিতে তিনি ব্যক্তিজীবনের সকল আনন্দ দূরে ঠেলে একটি স্বাধীন মাতৃভূমির স্বপ্নকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য বিবেচনা করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিলেন অতি সাধারণ তরুণ, যুবক। কিন্তু তিনি ‘লন্ডনে ডাক্তারি পেশা, বিলাসবহুল জীবন, দামি গাড়ি হাঁকানো, প্রিন্স চার্লসের দর্জিকে দিয়ে স্যুট বানিয়ে পড়া, বিমান চালানোর প্রাইভেট লাইসেন্স সঙ্গে রাখা এক অঘোষিত রাজপুত্র। তখন ত্রিশ বছরের টগবগে জাফরুল্লাহ । এইরকম জীবন পেছনে ফেলে মাতৃভূমির ডাকে সাড়া দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য ছুটে আসা মানুষ শুধু বাংলাদেশে কেন পৃথিবীতে-ই বিরল। জাফরুল্লাহ সেইরকম একজন মুক্তিযোদ্ধা।
লন্ডন শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সভা-সমাবেশ চলছে, তুলে ধরা হচ্ছে পাকিস্তানিদের গণহত্যার চিত্র। সেসব সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন বিদেশিরা। লন্ডনের প্রখ্যাত হাইড পার্কে এরকম একটি সমাবেশ চলছিল। সমাবেশের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এই যে পাসপোর্ট ছিঁড়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব বর্জন করলেন, এই সিদ্ধান্ত কী হঠাৎ করে, না চিন্তাভাবনা করে নিয়েছিলেন? হাসতে হাসতে তিনি যা বলেছিলেন, তা ছিল এমন,- ‘‘পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলা ছিল পাকিস্তানের গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। তোমরা আমাদের হত্যা করছ, আমি তোমার পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললাম, নাগরিকত্ব বর্জন করলাম।’’
১৯৭১ সালের মে মাসের শেষলগ্নে পাসপোর্ট- নাগরিকত্বহীন ডা. জাফরুল্লাহ ও ডাক্তার মবিন কলকাতায় আসার উদ্যোগ নিলেন। ট্রাভেল পারমিট জোগাড় করে সিরিয়ান এয়ারলাইন্সে রওনা দিলেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। ট্রানজিট দামেস্ক। বিপত্তি বাঁধল সেখানেই। দামেস্ক বিমান বন্দরে সিরিয়ার সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তান সরকার তাদের গ্রেফতার করতে চাইল। উড়োজাহাজের সব যাত্রী নামলেন। নামেননি শুধু তাঁরা ২ জন।কিন্তু উড়োজাহাজের ভেতর আন্তর্জাতিক জোন, কাউকে গ্রেফতার করা যায়না। বিমানবন্দরে উপস্থিত পাকিস্তানি একজন কর্ণেল দাবি করলেন,‘‘আমাদের ২ জন নাগরিক উড়োজাহাজে, তাদেরকে আমাদের হাতে তুলে দেন।’’ দীর্ঘসময় চলে দেন-দরবার। অবশেষে পাকিস্তানি কর্ণেলকে জানানো হয়, তারা পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করছেন না। ট্রাভেল পারমিট নিয়ে ভ্রমণ করছেন। তারা পাকিস্তানের নাগরিক নন। সে যাত্রায় পাকিস্তানিদের হাত থেকে বেঁচে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. মবিন।
মে মাসের শেষে তাঁরা পৌঁছলেন মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টর আগরতলায়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য সেখানে গড়ে তুললেন একটি হাসপাতাল। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’’। ছন-বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ৪৮০ শয্যার সেই হাসপাতাল, অপারেশন থিয়েটার। যুদ্ধে গুরুর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশন করা হলো বাঁশের তৈরি এই হাসপাতালে। হাসপাতালটি গড়ে তোলার অন্যতম উদ্যোগতার নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র কার্ডিয়াক সার্জন ডা. এম. এ মবিন। প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একদল সেবাদানকানী, মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এড. সুলতানা কামালও তাদের একজন। মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ তখন এই অঞ্চলে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। সেই হাসপাতালটিই স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম দিলো‘ ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’’- নামে। যেটির আদি জন্ম ১৯৭১ সালে ভারতের মাটি আগরতলার বিশ্রাম গঞ্জে।
রাজনীতি নিয়ে ভিন্নমত ছিল মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু যোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। ১৯৭২ সাল থেকেই তিনি নিজের মতো করে আলাদা রাজনৈতিক আদর্শ বজায় রাখতেন। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আলাদা মত-পথের সন্ধানে ছিলেন। তাঁর চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মিলেছে, কতটা মেলেনি জানিনা। একজীবনে মানুষের সব চাওয়া-পাওয়া হিসাব মেলে না। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর না মেলাটাই স্বাভাবিক। তারপরও শেষ বয়সে তাঁর মাঝে ক্লান্তি দেখিনি। অপরের সমালোচনা শুনে তিনি থামেননি। মেলাননি চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। কাজ করে গিয়েছেন নীরবে। সেই কাজ মানুষের জন্য। মানবতার জন্য। সুন্দর একটা আগামী তৈরির জন্য।
১৯৭১ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। স্বাধীনতার পর তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে পাশে দাঁড়ান বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু জাফরুল্লাহ কে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন দেশ গড়ার জন্য এরকম দেশপ্রেমিক মেধাবী দরকার। তাই বঙ্গবন্ধু গণস্বাস্থ্যের জন্য জায়গা এবং হাসপাতালের নাম ঠিক করে গরীব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে জোহরা বেগম, পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম-সচিব এম.এ রব এবং ডা. লুৎফর রহমান সাভারে তাঁদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে ৫ একর জায়গা প্রথমে দিয়েছিলেন হাসপাতালের জন্য। বঙ্গবন্ধু আরও ২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ‘‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’’ এর জন্য। পরিবর্তিত ‘‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’’ – নামে যাত্রা শুরু করল ১৯৭২ সালে । আজও এই হাসপাতাল এবং ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি দেশের গরীব মানুষের চিকিৎসা জগতের এক মহিরুহ।
১৯৮২ সনে জেনারেল হোসাইন মোহম্মদ এরশাদ (সাবেক রাষ্ট্রপতি) ক্ষমতায় আসার পর তাঁর সাথে আলাপ করে জাতীয় ঔষুধ নীতি প্রবর্তনে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশীয় ঔষুধ শিল্পের যে বিকাশ, তা সেই বৈপ্লবিক ঔষুধ নীতির সুফল। এখন ১৭ কোটি মানুষের চাহিদার ৯৫ শতাংশেরও দেশি ঔষুধ বাংলাদেশ উৎপাদন করে এবং বিদেশে ও রফতানি করে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ঔষুধ রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে অন্যতম।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সমালোচনা করে বলা হয়, সামরিক শাসক সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জিয়া ও এরশাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। সুসম্পর্ক থাকার বিষয়টি অসত্য নয়। সামরিক সরকারের সঙ্গে শুধু ডা. জাফরুল্লাহর সুসম্পর্ক ছিল, আর কারও ছিলনা? এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ নিজের জন্য সামান্যতম কোনো সুবিধা নিয়েছেন; এমন কথা কেউ কেউ বলতে পারেন না। দেশের জন্য, প্রতিষ্ঠানের জন্য করেছেন অনেককিছু। তবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সম্পদের পরিমাণ হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা কিন্তু ডা. জাফরুল্লাহ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, মালিক নন। তাছাড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মালিক কোনো ব্যক্তি নন; জনসাধারণ।
শুধু চিকিৎসাসেবা, সমাজ পরিবর্তনে নন, নারীদের এগিয়ে নিতেও ডা. জাফরুল্লাহ’র ভূমিকা অপরিসীম। তাঁর স্ত্রী শিরিন হক নারী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় শিরিন হক নারী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সেসময় শিরিন হক, নাসরিন হক- দু’ বোন সামনের কাতারে ছিলেন। ৮৮ সালের বন্যার সময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মীরা স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে সারাদিন রুটি বানাত। সেই রুটি ও গুড় বিতরণ করত ক্ষতিগ্রস্থদের কাছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গণমানুষের প্রতিষ্ঠান। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক কথা হয়। প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করেছিলেন। যে কাজ নারী- ‘পারে না’- বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত, সেসব কাজে তিনি নারীদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। ইলেক্ট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ড্রাইভার হিসেবে নারীদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রথমে সামনে নিয়ে আসে। সাংবাদিকরা ডা. চৌধুরীকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘নারীরা সিদ্ধান্ত নিতে সবসময় স্থির থাকে। গাড়ী চালক হিসেবে তারা খুব ভাল করবে।’’ ইংল্যান্ডের একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, ‘‘তিনি সেখানে দেখেছেন নারীরা খুব একটা দুর্ঘটনায় পড়েন না। তাছাড়া তাদের কর্মসংস্থানেরও দরকার আছে।’’ ঢাকা অরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সাল থেকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মী সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৫ ’শ, এর মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ নারী।
তবে এভাবে সবাই পারে না। মানুষের জন্য কাজ করতে ভিতর থেকে একটা তাগিদ দরকার। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তাগিদটা ভেতর থেকেই ছিল। আর ছিল বলেই এ বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজ করেছেন মানবতার জন্য, মানুষের জন্য।
মৃত্যুর আগে একজন জাফরুল্লাহ অনেক কিছুই করেছেন। তিনি হুট করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া (সাবেক প্রধানমন্ত্রী)’র উপদেষ্টা হলেন। বেগম জিয়ার সামনে বিএনপির ভুলগুলোর সমালোচনা স্পষ্ট ভাষায় করলেন। বাদ থাকল না ১৫ আগস্টে জন্ম পালন নিয়ে সমালোচনাও। সে সমালোচনা কেউ পছন্দ করেননি। দলে নির্দেশ আসে, জাফরুল্লাহকে যেন বেগম জিয়ার কাছে না নেওয়া হয়। জাফরুল্লাহ বিএনপি’র সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে দেন। তিনি আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক লোক ছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশে হত্যা, ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হলে ১৯৭৯ সনে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠন করে নৌকার প্রার্থী কর্ণেল (অব)জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করে মাঠে নামেন। দেখেছি বিভিন্ন ইস্যুতে সভা- সমাবেশে কথা বলতেন। দাবি জানাতেন। সরকারের ভালোমন্দের সমালোচনা করতেন৷
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী, তৎকালীন এডিসি, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, তৎকালীন ক্যাপ্টেন রব এবং তাঁর নিজের জীবন রক্ষা করেছিলেন, অতর্কিত এক বিমান হামলা থেকে। রক্ষা পায় স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই বিমানে কে হামলা করেছিল সেই দিন। নিশ্চয়ই তখন সেটা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঐদিন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী কে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চাইতেও। এই বিষয়ে পরবর্তীতে আর কোনো আলোচনা হয় নাই, কেউ তাদের নামও নিচ্ছে না। কিন্তু মানুষ কি জানে না ওরা কারা ছিল? ডা. জাফরুল্লাহর জানার খুব ইচ্ছে ছিল; কিন্তু আর কোনো দিন তাঁর জানা হবে না। তবে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেই প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন আমাদের কাছে। উত্তর খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের। ভবিষ্যতে এর সঠিক উত্তর বের হয়ে আসবে, এ প্রত্যাশা।
ডা. জাফরুল্লাহ যেসব কাজ করেছেন সেগুলোর জন্য হয়তো আলাদা করে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সহজ সরল জীবনযাপনে তাঁর নিজের চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে ছিলেন নির্মোহ। নিজের প্রকল্পগুলো লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করার কথা কখনো ভাবেননি। তাছাড়া তাঁর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যে মূল্যে মানুষকে চিকিৎসা দেয়া হয় সেটি অবিশ্বাস্য রকমের কম। দেশে চিকিৎসাসেবা যখন অত্যধিক মুনাফা অর্জনের ব্যবসায় পরিণত সেই সময় এ দৃষ্টান্ত বিরলতম। স্বাভাবিকভাবে তিনি ‘গরীবের ডাক্তার’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের কিভাবে কল্যাণ হবে সেই চিন্তার বাইরে অন্য কোনো ভাবনা তাঁর মনে কখনো স্থান পায়নি। একেবারে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুর মুহূর্তেই একই চিন্তা ছিল তাঁর মহতী।
তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, আপনার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে, আপনার কখনো মনে হয় না এখান থেকে নিজের কিছু পাওয়ার ছিল? প্রতিত্তুরে, ‘‘না, না আমি টাকা- সম্পদ দিয়ে কী করব?’’
তাঁর মানবতার পরিচয় ফুটে উঠে অনেককিছুতে। যেমনঃ বিলাতে ডাক্তারি পড়া শেষ না করে যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আগরতলায় যুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে গড়ে তুললেন ৪৮০ শয্যার ‘‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’’। সেখানে রোগীদের সেবার জন্য অনেক নারীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেন।
সাধারণ নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োগের এ পদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ‘‘ল্যানউসে’’- প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়। পরে বহির্বিশ্বে তাঁর পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দালনের সমর্থক ও সংগঠন হিসেবে সুখ্যাতি পায়। এই কিংবদন্তি পুরুষ দেশের রাজনীতি, ঔষুধ নীতি প্রবর্তন, চিকিৎসাসেবা, সমাজ পরিবর্তন, দেশে গণতন্ত্রের চর্চা, নারীদের প্রশিক্ষণ ও অধিকার, অবাধ নির্বাচনের জন্য লড়াই এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ স্বাধীনতা পুরস্কার, ১৯৮৫ সনে রামন ম্যাগসাইসাই, সুইডেন থেকে বিকল্প নবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড-১৯৯২ সন, আমেরিকার বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক হেলথ হিরো, ২০০২ সনে মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার- ‘‘স্বাধীনতা দিবস পদক ও পুরস্কার’’- সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অসংখ্য সম্মাননার স্বীকৃতি তাঁর ঝুড়িতে আছে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সম্মান বাংলার আপামর জনগণের হৃদয় নিংড়ানো উচ্ছ্বাস ভালবাসা। যিনি আজীবন স্রোতের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ৮১ বছর বয়সেও হুইল চেয়ারে বসে মিছিলের সামনে থেকে মানুষের ভোট, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ও ভাতের অধিকারের সংগ্রামে শেষ নিঃশ্বাসের ত্যাগ পর্যন্ত ছিলেন।
তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের আচরণে মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানে হামলা করেছে দলীয় কিছু কর্মীরা, মাছ চুরির মতো ঘটনাকে নাটক বানিয়ে মামলা দিয়ে তাঁকে হয়রানি করা হয়েছে। কিন্তু তিনি মুখ ফিরিয়ে নেননি। যখনই দরকার কাজ করেছেন , সরকারের উদ্দেশ্যে যথাযত পরামর্শ বা আহবান ঠিকই জানিয়েছেন।
যখন কোভিড মহামারীর আতংক, তখন তিনি কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই হয়েছিল তাঁর চিকিৎসা। তিনি বলেন, ‘‘যে হাসপাতাল তৈরি করলাম, সেখানে যদি নিজে আস্থা না রাখি, সাধারণ মানুষ আস্থা রাখবেন না।’’ করোনা চিকিৎসায় দামি ঔষুধ গ্রহণ করতে রাজি হননি। তাঁর যুক্তি ছিল- ‘‘প্রথমত, করোনা চিকিৎসায় এত দামি ঔষুধ দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, যে ওষুধ কেনার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের নেই, সেই ওষুধ আমি খাব না।’’, কোনো ডাক্তার তাঁর মত পরিবর্তন করাতে পারেন নি।
আবার যখন তাঁর কিডনি রোগ ধরা পড়ল, তাঁর আমেরিকার বন্ধুরা তাঁকে আমেরিকায় নিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। কারণ বাংলাদেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট আইন পরিবর্তনের জন্য তিনি আন্দোলন করেছিলেন। বাংলাদেশের আইনে কাছের আত্মীয় ছাড়া কেউ কিডনি দান করতে পারেন না। এতে মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
তাঁর কথা ছিল- ‘‘দেশের সাধারণ মানুষ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সুযোগ পাবে না, আর আমি আমেরিকা থেকে ট্রান্সপ্লান্ট করে আসব বা দেশে মিথ্যা কথা বলে করতে হবে, তা হয় না। আমি করব না। বরং ডায়ালাইসিস করব, যে সেবা গরীর মানুষকেও দিতে পারব।’’,
অতঃপর জীবনে ইতিবাচক সকল কর্মের মধ্যদিয়ে চলে গেলেন দেশের একজন একনিষ্ঠ সেবক। শেষ মুহূর্তে জীবন বাঁচাতে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখানের মধ্যেও দেশের প্রতি তাঁর আনুগত্য ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট। ১১ এপ্রিল ২০২৩ সালে তাঁর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের আরেকটা ইতিহাসের সমাপ্তি হলো।
এই ইতিহাস থেকে আমরা কে কতটা কি শিক্ষা নেবো জানি না। তবে সঠিক শিক্ষা নিতে পারলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পেশাগত আদর্শ এবং সততা বাংলাদেশের চিকিৎসা পরিবেশ এবং উপরে বর্ণিত ব্যবস্থাকে নিঃসন্দেহে আরো উন্নতির দিকে দেশকে অগ্রসর করে নিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। মানুষ ভালো কাজও আজকাল বাঁকা চোখে দেখে। সুযোগ পেলেই সমালোচনার বাঁশি নিয়ে মাঠে নামে। মুহূর্তে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। কোভিডের পর আমরা অনেককিছুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না । অপরের ভালো দেখে স্থির থাকে পারি না। মানুষের ভিতরে হিংসা-বিদ্বেষ এখন সবচেয়ে বেশি।
তবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী শেষ সময়ে একটি কথা বলেছিলেন,- ‘‘দেশের মানুষের জন্য আরও অনেককিছু করার ছিল।’’ তাঁর আরও স্বপ্ন ছিল, চিকিৎসা বাণিজ্য বন্ধ করার। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের এবং সেই স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে তাঁর আমৃত্যু লড়াই ছিল। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, জিততে চাইলে মানুষ না-ও জিততে পারে; কিন্তু কোনো মানুষ যদি প্রতিজ্ঞা করে তিনি হারবেন না, তাহলে তাঁকে হারানো সম্ভব নয় কিছুতেই। সেরকম মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু হার মানে না কিছুতেই। আমাদের তেমনি একজন হার না মানা যোদ্ধা ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। জাফরুল্লাহ’র মতো সবাই হতে পারে না। আর পারে না বলেই চলে যাওয়ার পর অনেক সম্মান পেয়েছেন তিনি।
ডা. চৌধুরী সম্পর্কে তাঁর কিছু বন্ধু মন্তব্য করেছেন। লিখেছেন তাঁর গুণ এবং ত্যাগের নানান বিষয়ে। এই মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে রাষ্ট্র কতটুকু করবে, কি করবে বা করে, তাতে কিছুই যায় আসে না। রাষ্ট্রের মানুষ জানে, তাঁদের হৃদয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আসন মুকুটহীন সম্রাটের সিংহাসনে কিন্তু শারিরীকভাবে তিনি নেই। তবে তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠান আছে, থাকবে। জনগণের ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। জনগণই তাদের প্রয়োজনে টিকিয়ে রাখবে ‘‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’’।
ডা. জাফরুল্লাহ ’র মৃত্যুর পর অনেককিছুর উর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, ভালো লেগেছে। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা সামাজিক মাধ্যমে ডা. জাফরুল্লাহ’র ইতিবাচক অবস্থানগুলোর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু দেশ ও জাতির প্রকৃত কল্যাণকামী হিসেবে তাঁর যে সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল সেটি সবচেয়ে বড়। তিনি যা বিশ্বাস করতেন অকুণ্ঠচিত্তে তা জোর গলায় প্রকাশ করতেন। কারো মন জুগিয়ে কথা বলতেন না। এটি তাঁর সততার অন্যতম দৃষ্টান্ত। স্বাস্থ্যখাত নিয়ে চিন্তা ও কর্মের পাশাপাশি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিরোধ কমিয়ে এনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টার জন্যও প্রশংসিত হয়েছেন। আর সে জন্য বলি,- “হে কিংবদন্তি ক্ষণজন্মা দেশপ্রেমিক তোমার কোন তুলনা নেই”।
তুমি অতুলনীয়- তুমিই আমাদের প্রেরণা।
লেখকঃ
গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী, লোক সাহিত্যিক, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মোমেরিয়াল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট। পিএইচডি ফেলো।