মির্জা আবুল কাসেম :
যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিসভায় প্রথমবারের মতো স্থান পেলেন ব্রিটিশ বাঙালি, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত টিউলিপ সিদ্দিক ও রুশনারা আলী।
সৃষ্টি হলো আরেক নতুন ইতিহাস। যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিসভায় প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিয়ে ইতিহাস গড়লেন বাংলাদেশি বংশোভূত দুই নারী।
তাদের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক, অপরজন রুশনারা আলী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ পূর্ণমন্ত্রী আর রুশনারা হয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। তাদের এই অর্জনে লন্ডনে বাঙালি কমিউনিটিতে আনন্দ বইছে। যুক্তরাজ্যের সীমানা পেরিয়ে সেই আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়েছে এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে। সামাজিক মাধ্যমে তাদের ছবি শেয়ার করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।
যুক্তরাজ্যে নির্বাচনের পরপরই জোর আলোচনা চলছিল বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে। লেবার পার্টির মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো এমপি নিশ্চিত ঠাঁই পাবেন। কিন্তু স্টারমার তার প্রথম কার্যদিবসে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ২১ জনকে নিয়োগ দেন এবং সেখানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি ছিলেন না। তারপরও সবাই ধারণা করছিলেন অন্য মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশি কোনো এমপি নিয়োগ পাবেন। সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। স্টারমারের মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেবার পার্টির প্রার্থী টিউলিপ সিদ্দিককে নগর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে গৃহায়ন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন রুশনারা আলী।
বিরোধী দলে থাকার সময় টিউলিপকে শ্যাডো বা ছায়ামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল লেবার পার্টি। ২০২১ সালে তিনি শ্যাডো নগরমন্ত্রী এবং পরে শ্যাডো শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ব্লুমবার্গ গতকাল এক প্রতিবেদনে টিউলিপের দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনের উত্তর-পশ্চিমে হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেট এলাকায় চারবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।
সাবেক শহরমন্ত্রী এন্ড্রু গ্রিফিথ ফিন্যান্সিয়াল নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এই পদের জন্য তিনিই সবচেয়ে যোগ্য। আমরা পূর্ববর্তী পার্লামেন্টে একসঙ্গে কাজ করেছি। তার কাছে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেয়েছি। টিউলিপ সিদ্দিককে সবসময় পার্লামেন্টে নীতিনির্ধারণীসহ নানা বিষয় নিয়ে সতর্ক তদারকি করতে হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট এলাকায় অর্থনৈতিক সহায়তা কাটছাঁটের ঘোষণা এলে প্রতিবাদ করেছেন। পাশাপাশি জনগণের পর্যাপ্ত আর্থিক সহযোগিতায় কাজ করেছিলেন। এজন্যই তাকে নগর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
গত জুনে ইনভেস্টমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন কনফারেন্সে টিউলিপ সিদ্দিক বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যে সবাইকে আর্থিক সুযোগের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য লেবার পার্টি কাজ করবে। বিশেষত লেবার পার্টি পেনশন স্কিম, অভ্যন্তরীণ স্টক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে। দায়িত্ব পাওয়ার পর ফিন্যান্সিয়াল নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টিউলিপ সিদ্দিক বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা এবং প্রবৃদ্ধির মাঝখানের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।’
টিউলিপ সিদ্দিক বরাবরই কনজারভেটিভ পার্টির নানা নীতির বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিশেষত ২০২২ সালে ক্রিপ্টো ডোনার ক্রিস্টোফার হারবোর্ন কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গে ৫ লাখ পাউন্ডের একটি ডিজিটাল হাবের চুক্তি সমঝোতা করার চেষ্টা করেন। টিউলিপ সিদ্দিক তখন প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি পার্লামেন্টে বলেছিলেন, ‘ফ্রান্সের সরকারের উচিত ক্রিপ্টোকারেন্সি প্ল্যাটফর্মে নীতিনির্ধারণী আইন প্রয়োগ করা। ডিজিটাল হাব বা এনএফটির মতো বিশ্বস্ত নয়Ñ এমন প্ল্যাটফর্মে জনগণের অর্থ বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ’। তিনি গোটা প্রকল্পকে ‘অযথা’ পরিকল্পনা বলে অভিহিত করেন। ওই সময় বিনিয়োগকারী নির্বাচনের বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছিলেন।
অনেকের মনে খটকা লাগতে পারে- নগরমন্ত্রী হলে টিউলিপ সিদ্দিকের কাজ কী? নগরমন্ত্রী বলা হলেও এই মন্ত্রণালয় যুক্তরাজ্যের কোষাগারের অর্থসচিবের পদ। অর্থাৎ তিনি লন্ডনকেন্দ্রিক যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা, সম্ভাবনা, সমন্বয় নিয়ে কাজ করবেন। কোষাগারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকবে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো সার্বিক দায়িত্ব তার নয়। মূলত লন্ডন শহরের আর্থিক নীতিমালা প্রণয়ন, সমন্বয় সাধন এবং যেসব প্রযুক্তিকে নজরদারিতে রাখা হয় অর্থাৎ ক্রিপ্টোকারেন্সি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করবেন। নগরমন্ত্রীর পদটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যুক্তরাজ্যের লন্ডনকেন্দ্রিকতা দেশটির অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই টিউলিপের ওপর গুরুভারই রয়েছে।
৪১ বছর বয়সি টিউলিপ লেবার পার্টির হয়ে আথির্ক সেবা খাতে দলীয় নীতি প্রণয়নে যুক্ত আছেন ২০২১ সাল থেকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ ২০১৫ সালে প্রথমবার এমপি হন। পরে ২০১৭ ও ২০১৯ সালেও পুনর্নির্বাচিত হন। এর আগে বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকের মেয়ে টিউলিপ লন্ডনের মিচামে জন্মগ্রহণ করেন। টিউলিপের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্মেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন এবং সেইভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে কাজ করেন টিউলিপ, যিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হন। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট নেতা বারাক ওবামার প্রচারাভিযানেও অংশ নেন।
২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালি নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন টিউলিপ। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে স্থানীয় পার্টির সদস্যদের ভোটে টিউলিপ তৎকালীন হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে লেবার পার্টির হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার টিকিট পান।
অন্যদিকে রুশনারা আলী যুক্তরাজ্যের এবারের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে টানা পঞ্চমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড স্টেপনি আসন থেকে ১৫ হাজার ৮৯৬ ভোট পেয়ে জিতেছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আজমল মাশরুর পেয়েছেন ১৪ হাজার ২০৭ ভোট।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা। লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের এই আসনে ২০১০ সাল থেকে টানা এমপি নির্বাচিত হয়ে আসছেন তিনি।
রুশনারা আলীর জন্ম সিলেটের বিশ্বনাথে । বয়স যখন সাত বছর, তখন যুক্তরাজ্যে আসেন তার পরিবার।
তিনি অক্সফোর্ডের সেন্ট জনস কলেজ থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।