জগন্নাথপুর টাইমসসোমবার , ১৫ জুলাই ২০২৪, ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অর্থনীতি
  2. খেলা
  3. গ্রেট ব্রিটেন
  4. ধর্ম
  5. প্রবাসীর কথা
  6. বাংলাদেশ
  7. বিনোদন
  8. বিশ্ব
  9. মতামত
  10. রাজনীতি
  11. ল এন্ড ইমিগ্রেশন
  12. লিড নিউজ
  13. শিক্ষাঙ্গন
  14. সাহিত্য
  15. সিলেট বিভাগ
 
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সিলেট অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যার কারণ ও করণীয় -মোহাম্মদ এমরান হোসেন

Jagannathpur Times Uk
জুলাই ১৫, ২০২৪ ৩:৩৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সিলেট অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যার কারণ ও করণীয় –

মোহাম্মদ এমরান হোসেন :

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ প্রায়ই নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়। এগুলোর মধ্যে বন্যা উল্লেখযোগ্য। দুঃখ, দারিদ্র্য ও অভাবের মতো বন্যাও যেন এ দেশের মানুষের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতি বছরই বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় এ দেশের মানুষকে। বন্যা দাপটের বছর ১৯৫৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩২টি বড় ধরনের বন্যা আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৭টিকে মহাপ্রলয়ংকরী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয় ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে। বিশেষভাবে সিলেট অঞ্চলে ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে উল্লেখযোগ্য বন্যা হয়।  তবে ২০২২ ও ২০২৪-এর বন্যা ব্যতিক্রম, ১২২ বছরের ইতিহাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জে এমন বন্যা হয়নি। ২০২২-এ সিলেটের সঙ্গে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ফসল ও মানুষের বাড়িঘর, রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে অতিরিক্ত দাবদাহের সঙ্গে বন্যাও দেখা গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জিতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদী এবং হাওরে এসে মিশে ভৈরবে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়। বর্তমানে একদিন একটু ভারী বৃষ্টি হলেই ঐ পানি উজান থেকে আসা পানির সঙ্গে মিশে কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর দুই কূল প্লাবিত করে পানি নগরসহ সিলেট বিভাগের একাধিক জেলায় প্রবেশ করে এবং রাতারাতি সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে চলে যায়।

বন্যা ও আকস্মিক বন্যার কারণের সঙ্গে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান ও গঠন, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, বায়ুপ্রবাহের দিক ও নদী ব্যবস্থার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের পরিপ্রেক্ষিতে ফানেল আকৃতির (Funnel Shape) বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূপ্রাকৃতিক গঠন বন্যা ও বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার উল্লেখযোগ্য প্রধান কারণ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ বিভিন্ন নদী বাংলাদেশকে আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। প্রধান এই তিনটি নদীর উৎস চীন, নেপাল, ভারত ও ভুটান। কিন্তু এসব নদীপ্রবাহের ৮০ শতাংশেরও বেশি পানি বাইরে থেকে আসে এবং বন্যার জন্য দায়ী ৯০ শতাংশ পানিই এই তিনটি নদী নিয়ে উজান থেকে আসে। এই তিনটি নদীর মোট অববাহিকা এলাকার পরিমাণ ১৫ লাখ ৫৪ হাজার বর্গকিলোমিটার, যার মাত্র ৭ শতাংশ এলাকা এ দেশে অবস্থিত।

সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীর উত্পত্তিস্থল ভারত হওয়ায় প্রতি বছর ক্যাচমেন্ট এলাকায় ভারী বৃষ্টির কারণে যে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়, এর সবই চলে আসে বৃহত্তর সিলেটে। এতে প্রচুর পরিমাণ পলিমাটিও বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের (বানিপা) তথ্যমতে, ভারত থেকে প্রতি বছর ১.২-২.৪ বিলিয়ন টন পলি নদীবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বন্যার ফলে নদীর দুই কূল প্লাবিত হয়ে হাওরসহ নদীগুলোর তলদেশ পলি পড়ে ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আগে এ ধরনের বন্যার পানি দ্রুত বৃদ্ধি ও হ্রাস পেত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই পানি দ্রুত নেমে না যাওয়ায় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেখা দিচ্ছে। তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও এর মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার জন্য প্রয়োজন বিদ্যমান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা জোরদার করা।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মিটিওরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথিউ কোল বলেন, বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী মৌসুমি বায়ু অনেক বেশি আর্দ্রতা বহন করতে পারে। আমরা এখন যে বিপুল বৃষ্টিপাত দেখছি, তা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ষা মৌসুমে বায়ুতে এল নিনো-লা নিনা আবহাওয়া চক্র, ভারত মহাসাগরীয় ডাইপোলসহ মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডলের একাধিক ওভারল্যাপিং প্যাটার্ন লক্ষ করা যায়। এদিকে একাধিক দপ্তর কর্তৃক পানি প্রবাহের পথ সংক্ষিপ্ত করে ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ ছাড়াও পানি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া মানুষ খাল, বিল, ছোট ছোট নদী ভরাট করে নানা অবকাঠামো বা স্থাপনা গড়ে তুলছে। ফলে আস্তে আস্তে নদীর তলদেশে পলি পড়তে থাকে। এর ফলে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়, যা বন্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ।

ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং অব্যাহত রাখলেও আকস্মিক স্থানীয়সহ আশপাশের কেচমেন্ট এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে উজান থেকে আগত বিপুল পানি  বাংলাদেশের উজানের নদীগুলোর সীমান্তের শূন্য পয়েন্ট থেকে ভৈরব (মেঘনা) পর্যন্ত বহন করার সক্ষমতা আছে কি না, সমীক্ষা করা প্রয়োজন। প্রতি বছর বন্যার পানি নদীর দুকূল প্লাবিত করে পার্শ্ববর্তী হাওরে প্রবেশ করায় পলি পড়ে হাওরের তলদেশ ভরাট হয়ে হাওরের পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় নদীর দুপাশে ফ্লাড প্লেইন (Flood Plain) রাখাসহ পানি দ্রুত নিষ্কাশনের  জন্য নদীর প্রস্থ কেটে বাড়ানো যেতে পারে। ফলে শুধু নদী খনন করলেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব হবে না। তাই সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খননের সাথে উজান বা শূন্য লাইন থেকে আগত ছোট ছোট নদ-নদী ও ছড়ার খননকাজের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় পর পর হাওরগুলোর খনন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে নদীর দুপাশের ফ্লাড প্লেইন এ অস্থায়ী বসতি স্থাপন, যা দ্রুত সরিয়ে নেওয়া সম্ভব।

বর্ষা মৌসুমে সুরমা নদীর উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি ছাড়াও যাদুকাটা, চেলা নদী, চলতি নদী, চানপুর ও লুত্মা/লাকমা ছড়া দিয়ে উজানের বিপুল পানি সুনামগঞ্জ জেলার সুরমা নদীর অংশে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ভারী বর্ষণে উজান থেকে বিপুল পানি বহন করার ক্ষমতা নদীগুলোর না থাকায় মূল নদী সুরমাসহ সুনামগঞ্জ অংশে অন্যান্য নদীর আশপাশে বন্য ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কিশোরগঞ্জ জেলার অল ওয়েদার (All weather) সড়কের কারণে সুরমা নদীর পানির সঙ্গে উজানের ছোট-বড় নদী ও ছড়ার আগত পানি সরে যেতে না পারায় স্থানীয়ভাবে বন্যা সৃষ্টির কারণ হতে পারে, যা পরিবীক্ষণ করা যেতে পারে। স্বাভাবিক বন্যার হাত থেকে শহর রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা বা বেষ্টনীমূলক বাঁধ নির্মাণ করলেও বন্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না-ও হেতে পারে। এজন্য অতিবৃষ্টির কারণে শহরের অভ্যন্তরে জমা হওয়া পানি নিষ্কাশনের বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া সুরমা ও কুশিয়ারা ড্রেজিং কাজ একই সময়ে করতে হবে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণে একাধিক ব্যবস্থা নিতে হবে  যেমন—ক. সাধারণ ব্যবস্থাপনা :

(১) Flood plain এলাকায় সহজে স্থানান্তরযোগ্য বসতি তৈরি করা, (২) নদীর দুই তীরে ঘন জঙ্গল সৃষ্টি করা, (৩) নদীশাসন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা, (৪) মাঠ, খাল বিল, নালা দখল মুক্ত করা, পুকুর, নালা, বিল প্রভৃতি খনন করা এবং সেচের পানি সংরক্ষণ করা।

খ. শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল প্রকৌশল ব্যবস্থাপনা :

(১) ড্রেজারের মাধ্যমে নদীর তলদেশ খনন করে পানির পরিবহনক্ষমতা বাড়ানো, (২) উজানের ৫৪টি নদী থেকে আসা পানিকে বাঁধের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে নিষ্কাশন, (৩) সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় পানির অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা, (৪) নদীর তীর স্থায়ী সুদৃঢ় কাঠামোর সাহায্যে সংরক্ষণ করা।

গ. সহজ প্রকৌশলগত ব্যবস্থাপনা : (১)

নদীর দুই তীরে বেড়িবাঁধ দিয়ে নদীর পানি উপচে পড়া বন্ধ করা, (২) সার্বিক বনায়ন সৃষ্টি করা, (৩) রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে সমীক্ষা-পূর্বক পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা, (৪) শহর বেষ্টনীমূলক বাঁধ দেওয়া এবং অতিবৃষ্টির ফলে শহরের অভ্যন্তরে জমা হওয়া পানি নিষ্কাশনের বিকল্প ব্যবস্থা রাখা।

ঘ. প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা :

(১) নদীর গতিপথে জমে থাকা পলি উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে অপসারণের ব্যবস্থা এবং পলি জমে যেসব হাওর, বিল ভরাট হয়ে গেছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমিক খননের ব্যবস্থা করা, (২) গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদী প্রবাহের পথ উন্মুক্ত রাখা, (৩) পরিবেশগত সমীক্ষা-পূর্বক রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বাঁধ তৈরি করতে হবে, যাতে সেগুলো পানির স্বাভাবিক গতিপথে বাধা সৃষ্টি না করা, (৪) নদীর পাড়ে ব্যাপকভাবে বনায়ন করে নদীভাঙন রোধ করা ইত্যাদি।

লেখক: জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার, সিলেট ও সাবেক পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিলেট

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি।