এস কে এম আশরাফুল হুদা,
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
১৯০১ সালের পর থেকে শুধু যুদ্ধের বছরগুলো বাদে প্রতি বছরই পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান বা চিকিৎসাবিজ্ঞান- এই তিন শাখায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
৩৪৬টি নোবেল পুরস্কার ও ৬৪৬ জন বিজয়ীর (নোবেল পুরস্কার তিনজন পর্যন্ত একত্রে পেতে পারেন) তথ্য বিশ্লেষণ করেছে নেচার । এর মাধ্যমে এটি দেখার চেষ্টা করেছে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য কী কী বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়।
এখন পর্যন্ত পাঁচজন ব্যক্তি দ্বিতীয়বার নোবেল পেয়েছেন। তারা হলেন- ফ্রেডেরিক স্যাংগার, জন বার্ডিন, কে. ব্যারি শার্পলেস, লাইনাস পলিং (২য়টি শান্তিতে) ও ম্যারি কুরি।
তথ্য বিশ্লেষণে নেচার জানায়, নোবেল পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত বয়স ৫৪। ২৪ জন বিজয়ী এ বয়সে নোবেল জিতেছিলেন। আর এমনিতে নোবেল বিজয়ীদের গড় বয়স ৫৮।
সবচেয়ে তরুণ বয়সে নোবেল জিতেছিলেন লরেন্স ব্র্যাগ। ১৯১৫ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে পদার্থবিজ্ঞানে এ পুরস্কার পান তিনি। বাবা উইলিয়াম ব্র্যাগের সঙ্গে একত্রে জিতেছিলেন লরেন্স। তাদের কাজ ছিল এক্স-রে ব্যবহার করে ক্রিস্টাল গঠন বিশ্লেষণ নিয়ে।
২০১৯ সালে রসায়নে নোবেল পাওয়া জন বি গুডেনাফ সবচেয়ে বেশি ৯৭ বছর বয়সে নোবেল জিতেছেন। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরি করে তিনিসহ মোট তিনজন নোবেল পান।
তথ্য জানায়, নোবেল জেতার সবচেয়ে বেশি সুযোগ রয়েছে পুরুষ হলে। আর আপনি যদি নারী হন, তাহলে নোবেল জেতার চেষ্টা করতে পারেন চিকিৎসা বা জীববিজ্ঞানে।
তবে নারী বিজ্ঞানীদের নোবেল পাওয়ার সুযোগ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে। পুরো বিশ শতকজুড়ে কেবল ১১টি নোবেল পেয়েছিলেন নারীরা। ২০০০ সালের পর থেকে নারীরা মোট ১৫ বার এ পুরস্কার জেতেন।
নোবেল পাওয়ার যোগ্য কাজ করে ফেলার পর আরও প্রায় দুই দশক অপেক্ষা করতে হয় বলে জানিয়েছে নেচার। তাই গড়ে বয়স ৪০-এর কোঠায় থাকলেই নোবেল পাওয়ার মতো কোনো প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে ফেলা ভালো।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজ ও পুরস্কার পাওয়ার মধ্যকার অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। ১৯৬০-এর আগে কাজ শেষ করার গড়ে ১৪ বছর পর পুরস্কার পাওয়া যেত। কিন্তু ২০১০-এর দশকে পুরস্কৃতদের গড়ে প্রায় ২৯ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
তবে এ অপেক্ষার একটা সীমানা ঠিক করা আছে। মৃত্যুর পর কাউকে নোবেল দেওয়া হয় না।
আর আপনাকে পুরস্কার অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।
জীববিজ্ঞান বা চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীরা প্রায়ই যৌথভাবে পুরস্কার পেয়েছেন। এ দুই শাখায় ৬৫ শতাংশ পুরস্কার দু-তিনজন একত্রে পেয়েছেন। রসায়নে ৫৫ শতাংশ পুরস্কার এককভাবে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীদের জন্য স্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ বাড়ানোর জন্য উত্তর আমেরিকায় জন্ম নেওয়া ও সেখানে বেড়ে ওঠা একটি বড় প্রভাবক বলে বিশ্লেষিত তথ্য ইঙ্গিত করছে। নোবেল পুরস্কারের প্রায় ৫৪ শতাংশ পেয়েছেন উত্তর আমেরিকার বাসিন্দারা। অন্য কোথাও জন্ম নিলে নোবেল বাগানোর সবচেয়ে বড় বিকল্প হলো উত্তর আমেরিকায় গিয়ে বাস করা। ইউরোপের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে এ সুযোগ খানিকটা কম।
নোবেল পুরস্কারের সুযোগ বাড়ানোর আরেকটি দারুণ উপায় হলো, যেসব ব্যক্তি ইতোমধ্যে এ পুরস্কার পেয়েছেন বা ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের গবেষণাগারে কাজ করা। অথবা যে ব্যক্তির মেন্টর নোবেল পেয়েছেন তার ল্যাবেও কাজ করা যেতে পারে।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘নোবেল বংশলতিকারও’ একটি ভূমিকা রয়েছে। গ্যাসের ধর্ম নিয়ে কাজের জন্য ১৯০৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতেছিলেন জন ডব্লিউ. স্ট্রাট। এরপর থেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিষ্য, শিষ্যদের শিষ্য এবং তস্য শিষ্য— সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২২৮ জন নোবেল পেয়েছেন।
স্ট্রাটের ছাত্রদের মধ্যে কেবল একজন, জোসেফ থমসন ১৯০৬ সালে নোবেল পান। কিন্তু এ থমসন ‘নোবেল বংশলতিকা’ টেনে নিয়ে গেছেন। তার ছাত্রদের নয়জন পদার্থবিজ্ঞানে এবং দুজন রসায়নে নোবেল পান। পদার্থে নোবেলজয়ীদের একজন ছিলেন তার ছেলে জর্জ প্যাজেট থমসন।
এই ছাত্ররা আবার অন্যদের মেন্টর হিসেবে ছিলেন, যাদের অনেকেই পরবর্তীকালে নিজেরা পুরস্কার জিতেছেন অথবা এমন শিষ্য বানিয়েছিলেন যারা নোবেল জয় করেছেন।
২০২৩ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া ৭৩৬ জন বিজয়ীর মধ্যে ৭০২ জন একই একাডেমিক পরিবারের অংশ। অর্থাৎ তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি নির্দিষ্ট সাধারণ সূত্রে কোনো না কোনোভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত।
বড় এই প্রাতিষ্ঠানিক বংশের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই কেবল ৩২ জন নোবেল বিজয়ীর।
এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো, জ্ঞান থেকে জ্ঞানের জন্ম হয়। আবার এমনও হতে পারে, আগের বিজয়ীরা তাদের ছাত্র বা বৈজ্ঞানিক উত্তরসূরিদের মনোনয়ন দিয়েছিলেন।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীদের মনোনীত হতে হয়। আর তাদের কারা মনোনয়ন দিতে পারবেন- সেটা ঠিক করে নোবেল কমিটি।
যথাযথ মেন্টর নির্বাচনের পাশাপাশি নোবেল পুরস্কারের সুযোগ বাড়ানো সম্ভব নির্দিষ্ট কিছু গবেষণা শাখায় কাজ করে।
১৯৯৫ খেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেওয়া ৬৯টি নোবেল পুরস্কারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অল্প কয়েকটি ডিসিপ্লিনেই বেশি পুরস্কার পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এসব পুরস্কারের অর্ধেকের বেশি দেওয়া হয়েছিল কেবল পাঁচটি বিষয়ে।
এসব পরিসংখ্যানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া কমিটি নেচারকে জানিয়েছে, যেকোনো প্রবণতার কারণ দেখার ক্ষেত্রে একাধিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে।
নোবেল কমিটির সদস্যরা ‘পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান বা চিকিৎসাক্ষেত্রে লিঙ্গ, জাতীয়তা ও কাজের ক্ষেত্রে মনোনয়ন বাড়ানোর লক্ষ্যে মনোনয়ন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটাতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন’।