এস কে এম আশরাফুল হুদা :
লন্ডনস্থ ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সেন্টারের নির্বাচন পরবর্তী ‘কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশে সরকারের সদ্য বিদায়ী হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেন্টার কর্তৃপক্ষ।
তাঁরা বলেন, পদাধিকার বলে বাংলাদেশ সেন্টারের সম্মানসূচক সভাপতি হওয়ার সুযোগ নিয়ে নানা অপরাজনীতি করেছেন হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম। তিনি বাংলাদেশে সেন্টারে পক্ষপাতমূলক আচরণ করে বিতর্কিত ও নিন্দনীয় ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হন।
গত ৭ অক্টোবর লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ তুলেন বাংলাদেশ সেন্টারের কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্ট কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক মোঃ দেলোয়ার হোসেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ভাইস চেয়ারম্যান তফজ্জল মিয়া ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলী বেবুল।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সেন্টারের ভাইস চেয়ারম্যান গুলনাহার খান, ভাইস চেয়ারম্যান মামুন রশীদ, চীফ ট্রেজারার শিব্বীর আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক জিলু, ফাইনান্স এন্ড ফান্ড রাইজিং উপ কমিটির আহবায়ক মোহাম্মদ ময়নুল হক, পার্মানেন্ট মেম্বার শাহানুর খান, পার্মানেন্ট মেম্বার মানিক মিয়া ও পার্মানেন্ট মেম্বার জাকির হোসেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই বাংলাদেশ সেন্টার। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রচারণার মূল কেন্দ্র। যুক্তরাজ্যে প্রথম বাংলাদেশী মিশন ছিল এই সেন্টারেই। ফলে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি কমিউনিটির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে এই সেন্টার। বর্তমানে বাংলাদেশ সেন্টার একটি নিবন্ধিত চ্যারিটি সংগঠন।
অতীতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত হতো এই সেন্টারের কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্ট কমিটি। সেন্টারের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর রোববার ইমপ্রেশন ইভেন্ট ভেন্যুতে বাংলাদেশ সেন্টারের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ও দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালায়েন্স- ‘রেড অ্যালায়েন্স’ এবং ‘গ্রিন অ্যালায়েন্স’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এতে কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্ট কমিটির শূন্য পদ পূরণে ১৭ জন ‘সাধারণ ও জীবন সদস্য’ এবং ১৮ জন স্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ‘রেড অ্যালায়েন্স’।
বাংলাদেশ সেন্টারের সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সভাপতি ব্যতীত কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সকল পদ নির্বাচিত সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। এজিএম ও নির্বাচন শেষে সেন্টারের ঐতিহ্য অনুযায়ী মোঃ দেলোয়ার হোসেনকে সর্বসম্মতিক্রমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পরবর্তী কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের সভায় অবশিষ্ট পদগুলো পূরণ করা হয়। আর পদাধিকার বলে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার। এই পদটি একান্ত সম্মানসূচক।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নব-নির্বাচিত কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্ট কমিটির ৫ ডিসেম্বরের সভায় আমন্ত্রণ সত্বেও উপস্থিত ছিলেন না সেন্টারের সভাপতি তৎকালীন হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম।
শিষ্টাচার মেনে তিনি অপারগতার কথাও জানান নি। ডেপুটি হাইকমিশনার হযরত আলী খানও একইভাবে অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সকল সদস্য, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, স্থায়ী সদস্য, কর্পোরেট সদস্য, সাধারণ ও আজীবন সদস্যসহ সকল সদস্যকে একটি সভায় আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি বিতর্কিত চিঠি প্রেরণ করেন। এতে ১৮ ডিসেম্বর একটি সভায় সকলকে তিনি আমন্ত্রণ জানান। অযাচিত উক্ত সভা আহ্বান বাংলাদেশ সেন্টার নিয়ে চরম উদ্বেগ ও বিতর্কের জন্ম দেয়।
যার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর হাইকমিশনারে অবৈধ সভা আহবানকে চ্যালেঞ্জ করে একটি চিঠি দেয় নির্বাচিত কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্ট কমিটি। এতে স্পষ্টভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, পদাধীকার বলে সম্মানসূচক পদে থেকে অযাচিত এমন সভা আহবানের কোনো সুযো্গ সেন্টারের সংবিধানে নেই। অবিলম্বে আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে সভাটি বাতিল করার আহবান জানানো হয়। কিন্তু হাইকমিশনার ওই চিঠির কোনো জবাব দেননি। বরং সভার ভেন্যু পরিবর্তন করে তা ইমপ্রেশন ইভেন্টস ভেন্যুতে করার নোটিশ জারি করেন। সভাপতি হিসেবে হাইকমিশনারের এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশ সেন্টারকে তুমুল বিতর্ক ও বিভাজনের ঝুঁকিতে ফেলে।
উদ্ভূত পরিস্হিতিতে সেন্টারের চেয়ারম্যান ও হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্ট কমিটির নির্বাচিত সকল সদস্য, প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের নিয়ে একটি সভা আহবানের জন্য সাধারণ সম্পাদক জনাব দেলোয়ার হোসেনকে অনুরোধ জানান। তাঁর অনুরোধের প্রেক্ষিতে ২৪ এপ্রিল ২০২৪ বাংলাদেশ সেন্টারের ভবনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সেন্টারের চেয়ারম্যান হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। সভাটি পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন। দীর্ঘ ৫ ঘন্টার বৈঠকে সমঝোতার করার চেষ্টা করা হয়। বৈঠকে রেড অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ছাড় দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু অপর পক্ষ গ্রিন অ্যালায়েন্সের একগুয়েমী মনোভাবের জন্য কোন সমঝোতা ছাড়া বৈঠক সমাপ্ত হয়।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “ওই ঘটনার পর থেকে নির্বাচিত কমিটির সঙ্গে হাইকমিশনার ও ডেপুটি হাইকমিশনারের অসংখ্য যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু কোনো গঠনমূলক সাড়া পাওয়া যায় নি। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, তাদের কর্মকাণ্ড কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অতীতে দায়িত্বে ছিলেন এমন কতিপয় সদস্যদের কূট কৌশলকে উৎসাহিত করছে; যারা আমাদের কমিউনিটির মধ্যে অপ্রয়োজনীয় বিভাজন তৈরি করতে ব্যস্ত। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতাকারী জনাব মুহিবুর রহমান মুহিবের নেতৃত্বাধীন গ্রিন অ্যালায়েন্স হাইকমিশনারের অন্যায় সমর্থন নিয়ে একটি পৃথক কমিটি গঠন করেছেন।”
এতে আরো বলা হয়, “সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, কমিটি গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে গ্রিন অ্যালায়েন্স পাল্টা কমিটি গঠন করে। ১১ জানুয়ারি ২০২৪ সালে একটি সভা করে। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব মুহিবুর রহমান মুহিব। অবৈধ এ সভায় বাংলাদেশ সেন্টারের পুরো ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি ছিনিয়ে নেয়ার সিন্ধান্ত নেন এবং ব্যাংকে তিনজনকে অন্তর্ভুক্ত করে অ্যাকাউন্টের অ্যাক্সেসের জন্য ভূয়া কাগজপত্র ও ম্যান্ডেট ফর্ম প্রদান করেন। বাংলাদেশ সেন্টারের নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অ্যাক্সেস পরিবর্তন করার অপচেষ্টা করা হলে ব্যাংক থেকে তাৎক্ষনিকভাবে অনুমোদিত অন্যতম স্বাক্ষরকারী হিসেবে সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনকে ব্যাংক ম্যানেজার ইমেইলে যোগাযোগ করেন।এরকম জালিয়াতির ইমেইল পেয়ে সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন সরাসরি ব্যাংকে যান। ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে মিটিং করেন।”
“এ তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন ফায়জুল হক, নাসিম আহমেদ ও সেন্টারের প্রধান নির্বাহী এস এম মোস্তাফিজুর রহমান।এই ম্যান্ডেট ফর্মে সত্যায়িত করেন জনাব মুহিবুর রহমান।যেহেতু এই কাজটি জালিয়াতি ও অসাংবাধানিক আমরা বাধ্য হয়ে পুলিশ এবং চ্যারিটি কমিশনকে ঘটনাটি রিপোর্ট করা সহ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছি।”
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “ এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেন্টারের এক্সিকিউটিভ কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ব্যাংক একাউন্ট নিয়ে অপতৎপরতার কারণে মুহিবুর রহমান মুহিবকে কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্ট কমিটি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার সুপারিশ করা হয়। তাকে ক্ষমা চাওয়ার এবং তাঁর কর্মকাণ্ড স্বীকার করার সুযোগ দেওয়াসহ বিষয়টি বন্ধুত্বপূর্ণভাবে সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
মুহিবুর রহমান থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনে সেন্টারের দুইজন ভাইস চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তাঁরা এক্সিকিউটিভ কমিটির পক্ষ থেকে দুইদফা নোটিশ প্রদান করেন। কিন্তু তিনি এই নোটিশ অবজ্ঞা করেন। কোন ধরণের যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন। বিষয়টি বন্ধুত্বপূর্ণভাবে সমাধানের চেষ্টা করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হলে তার অসহযোগিতার জন্য তা করা সম্ভব হয় নি। গত ৮ আগস্ট ২০২৪ কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্টের কমিটির সভায় মুহিবুর রহমান মুহিবের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অসাংগঠনিক আচরণ অব্যাহত ছিল। তিনি বাইরে থেকে লোকজন নিয়ে সভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন। যার জন্য পুলিশের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছিল। সাংগঠনিক আচরণবিধি লঙ্ঘন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়ে অপতৎপরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্টের ২৮ আগস্ট ২০২৪ এর সভায় সর্বসম্মতভাবে সেন্টারে মুহিবুর রহমানের সদস্যপদ আজীবনের জন্য বাতিল করা হয়। এছাড়া সভায় ফায়জুল হক ও নাসিম আহমেদের বিরুদ্ধে সতর্কতা নোটিশ প্রদান করা হয় এবং তাদেরকে কাউন্সিল অফ ম্যানেজমেন্টের পরবর্তী একটি সভার জন্য বরখাস্ত করা হয়।”
এছাড়া সেন্টারের প্রধান নির্বাহী এস এম মোস্তাফিজুর রহমান উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ব্যাংকের একাউন্টের ম্যান্ডেট ফর্মে আইন লঙ্ঘন করে স্বাক্ষর করেছেন বলে বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়। এতে বল হয়, সাংবিধানিকভাবে সেন্টারের প্রধান নির্বাহীর ব্যাংকের একাউন্টের স্বাক্ষরকারী হওয়ার কোন বিধান নেই। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান এ কাজ করা কোনভাবেই নিয়মমাফিক হয়নি। এ অপরাধে এস এম মোস্তাফিজুর রহমানকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নিয়ম মোতাবেক কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়। দুই দফায় তদন্ত কমিটির নিকট সশরীরে উপস্হিত হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি উপস্হিত হতে বা কোন বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে এস এম মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম এবং ডেপুটি হাইকমিশনার হযরত আলী খানের কর্মকাণ্ডে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তাঁদের অনৈতিক উৎসাহে বাংলাদেশ সেন্টারের বিভেদ আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের নিরপেক্ষ থাকা এবং অনৈক্যের বীজ বপন না করে ঐক্য লালন করা অত্যাবশ্যক। এতে বলা হয়, আমাদের যৌথ লক্ষ্য আমাদের কমিউনিটির কল্যাণ হওয়া উচিত। তাই হাইকমিশনারসহ সকল পক্ষকে তাদের কর্মকাণ্ড পুনর্বিবেচনা করার আহবান জানাচ্ছি। বাংলাদেশ সেন্টার ও বৃহত্তর কমিউনিটির কল্যাণে সেন্টারের নির্বাচিত কমিটির সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। আসুন আমরা আমাদের মতপার্থক্যগুলো ভূলে গিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী কমিউনিটি গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করি।