মির্জা আবুল কাশেম :
নোবেল পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও দামি পুরস্কার। বিশ্বমানব কল্যাণে সফল ও অসাধারণ উদ্ভাবন-আবিষ্কারের মতো মৌলিক অবদানের জন্য ১৯০১ সাল নারী, পুরুষ ও প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। আর যারা এ নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁরা নিজেরা আলোকিত হচ্ছেন সৃজনী কর্মের মাধ্যমে, পাশাপাশি তাদের দেশ সমাজ জাতিকে বিশ্বের বুকে সুনামের সাথে তুলে ধরছেন। এই আনন্দের বিপরীতে নিরানন্দও রয়েছে। সুখের বিপরীতে দুঃখ রয়েছে। এ অনুসন্ধানী তথ্যবহুল রিপোর্ট তাই তুলে ধরা হবে।
বিশেষ করে বিশ্বের অনেকদেশের নোবেলজয়ীকে জেলে যেতে হয়েছিল। কারা গিয়েছেন, কোন কোন দেশের তা এ প্রতিবেদনে থাকবে এবং পরিশেষে নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে অজানা তথ্য।
বাংলাদেশের আলোকিত মানুষ, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছিলেন বাংলাদেশের একটি আদালত। শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ১ জানুয়ারী ২০২৪, সোমবার তাঁর বিরুদ্ধে এই দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল । তবে নোবেল জয়ের আগে বা পরে কারাদণ্ড পাওয়া একমাত্র ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস নন।
এই বিশ্বে ড. ইউনূস ছাড়াও নোবেলজয়ীকে কারাদণ্ড দিয়েছে ভারত, বেলারুশ, মিয়ানমার, জার্মানি, চীন ও ইরান। তাঁরা হলেন—ভারতের অভিজিৎ ব্যানার্জি, ইরানের নার্গিস মোহাম্মদি, জার্মানির কার্ল ভন ওজিয়েতস্কি, মিয়ানমারের অং সান সু চি, চীনের লিও শাওবো এবং বেলারুশের আলেস বেইলিয়াৎস্কি।
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অভিজিৎ ব্যানার্জি ছাড়া বাকি সবাই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।অভিজিৎ নোবেল জিতেছেন অর্থনীতিতে।
অভিজিৎ ব্যানার্জি:
অভিজিৎ ব্যানার্জি ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। শিক্ষাজীবনে তাঁকে একবার জেলে যেতে হয়েছিল। সময়টা ১৯৮৩ সাল। তখন অভিজিৎ দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এমএ ক্লাসের শিক্ষার্থী। এক ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ১০ দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছিল। তা-ও আবার ভারতের আলোচিত তিহার জেলে রাখা হয়েছিল তাঁকে।
অং সান সু চি:
মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি ১৯৯১ সালে যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন তিনি গৃহবন্দী। পরে কয়েক দফায় তিনি মিয়ানমারে সরকারও গঠন করেন। কিন্তু সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। ২০২২ সালে দেশটির আদালত সু চিকে ৩৩ বছরের কারাদণ্ড দেন।
নার্গিস মোহাম্মদি:
ইরানের অধিকারকর্মী নার্গিস মোহাম্মদি ২০২৩ সালে শান্তিতে নোবেল পান। কিন্তু নোবেল পুরস্কার গ্রহণের জন্য তিনি অসলো যেতে পারেননি। কারণ, সে সময়টায় তাঁকে কারান্তরে কাটাতে হয়েছে। ইরান সরকার ২০২১ সাল থেকে তাঁকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছে। এমনকি নোবেল জয়ের পরও তাঁর ওপর থেকে শাস্তির খড়্গ নামেনি।
কার্ল ভন ওজিয়েতস্কি:
জার্মান নাগরিক সাংবাদিক কার্ল ভন ওজিয়েতস্কি ১৯৩৫ সালে শান্তিতে নোবেল জেতেন। কিন্তু তিনিও নোবেল পুরস্কার নিজ হাতে গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ, সেই সময়টাতে তিনি নাৎসি বাহিনীর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। অবশ্য পরেও আর কোনো দিন তিনি সেই পুরস্কার হাতে পাননি। ১৯৩৯ সালে কার্ল বন্দী অবস্থায়ই মারা যান।
লিও শাওবো:
চীনের রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী লিও শাওবো ২০১০ সালে নোবেল জেতেন। এর আগেই তাঁকে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের দায়ে ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল চীন সরকার। ২০১৭ সালে কারাবন্দী অবস্থায় ক্যানসারের চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চীনেরই একটি হাসপাতালে।
আলেস বেইলিয়াৎস্কি:
২০২২ সালে নোবেল জেতেন বেলারুশের অধিকারকর্মী আলেস বেইলিয়াৎস্কি। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের জুলাই মাসে তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে অনুসন্ধানী নানা তথ্য :
নোবেল পুরস্কার যেভাবে শুরু: নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করেন সুইডিস বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক আলফ্রেড নোবেল। আলফ্রেড তার জীবদ্দশায় ডিনামাইটসহ ৩৫৫টি উদ্ভাবন করেন।
এসবের মাধ্যমে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন তিনি। অর্জিত সব অর্থ দান করে ১৮৯৫ সালে একটি উইল করেন তিনি।
যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০১ সাল থেকে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য এবং শান্তি-এই পাঁচটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয় এবং পরে অর্থনীতি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৬৯ সালে।
কারা পায় পুরস্কার:
আলফ্রেড নোবেলের উইল মতে, পুরস্কার তাদেরই দিতে হবে, ‘যারা আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক, সেনাবাহিনীর সংকোচন বা অবলোপন ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ ও সেরাটা মানবজাতিকে উপহার দেবে।’
এই সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ তাদের নিজেদের কিংবা অন্যের নাম জমা দিতে পারে।
কোন দেশ থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়:
দুটি জায়গা থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তার মধ্যে শুধু নোবেল শান্তি পুরস্কারটি নরওয়ের অসলো থেকে আর বাকিগুলো দেওয়া হয় সুইডেনের স্টকহোম থেকে।
কারা সিদ্ধান্ত নেয়:
কাকে পুরস্কার দেওয়া হবে-সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি নামে নরওয়ের পার্লামেন্ট নিয়োজিত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি।
এর সদস্যরা প্রায়ই পার্লামেন্টের অবসরপ্রাপ্ত রাজনীতিক। কিন্তু সবসময় এমনটি হবে তেমনটা নয়। বর্তমান কমিটির প্রধান হিসাবে আছেন একজন আইনজীবী। একজন বুদ্ধিজীবীও আছেন।
যেভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়:
পুরস্কারের জন্য প্রথমে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া শেষ হয় প্রতি বছর ৩১ জানুয়ারি। ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বৈঠকে বসে নোবেল কমিটি।
বৈঠকে সব মনোনয়নপত্র আলোচনা করা হয় এবং প্রার্থীদের একটি তালিকা করা হয়। এরপর প্রত্যেক প্রার্থীকে মূল্যায়ন ও আলাদা আলাদাভাবে স্থায়ী উপদেষ্টা ও অন্যান্য পেশাজীবী দলের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হয়।
কাদের মনোনীত করা হয়:
নোবেল কমিটির সম্পূর্ণ আলোচনা সর্বদাই গোপন রাখা হয়। এমনকি গোপন রাখা হয় মনোনীত প্রার্থীদের তালিকাও। ‘৫০ বছরের গোপনীয়তা নিয়ম’ অনুযায়ী, পঞ্চাশ বছর পর মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়।
এবারের ৩২৯ জন প্রার্থীর তালিকাটিও নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটে সুরক্ষিত আছে। ভল্টের ভেতর সারিবদ্ধভাবে রাখা ফোল্ডারগুলোতে সবুজ ফোল্ডারে রয়েছে মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকা এবং নীল ফোল্ডারে রয়েছে সংশ্লিষ্ট চিঠিপত্র।
সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকাটি ছিল নোবেলের ১৯৭১ সালের আসরের। সে বছর নোবেল জিতেছিলেন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট। বিংশ শতকের স্নায়ুযুদ্ধের সময় পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যকার উত্তেজনা কমিয়ে আনতে তার নেওয়া পদক্ষেপের জন্য এ পুরস্কার পান তিনি।
বিজয়ীদের কী দেওয়া হয়:
প্রত্যেক বিজয়ীকে একটি পদক দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত নোবেল বিজয়ীরা যে পদক পেতেন, সেটা ছিল ২৩ ক্যারেট স্বর্ণের।
এরপর থেকে ১৮ ক্যারেট সবুজ স্বর্ণের ধাতবের ওপর ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া পদক দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া একটি সনদ ও মোটা অঙ্কের অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়।
এই অর্থের পরিমাণ এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার বা ১১ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটা প্রায় আট কোটি টাকা।
একটি ভুল বোঝাবুঝি:
আলফ্রেড ডিনামাইটসহ বেশ কিছু জীবনধ্বংসকারী বিস্ফোরক আবিষ্কার করেন। ফলে লোকেরা তাকে সেই সময় খুব একটা ভালো চোখে দেখত না।
এমনকি ১৮৮৮ সালের ১২ এপ্রিল যখন তার বড় ভাই লুডভিগ বেড়াতে গিয়ে ফ্রান্সের কান শহরে মারা যান তখন ফরাসি দৈনিক ‘লা ফিগারো’ প্রতিবেদনে লেখে, ‘মৃত্যুর সওদাগর গতকাল কানে মারা গেছেন।
তিনি হচ্ছেন নোবেল, ডিনামাইটের উদ্ভাবক।’ সেই খবরে এও বলা হয় কিভাবে লোকেদের দ্রুত সময় হত্যা করা যায়, সেই পদ্ধতি আবিষ্কার করে নোবেল ধনকুবের হয়েছেন।
অনেকের ধারণা এই নেতিবাচক সংবাদটি নোবেলকে খুব নাড়া দেয় এবং এর প্রতিক্রিয়াতেই তিনি মানুষের কল্যাণে কিছু করতে আগ্রহী হন।
ফলে তিনি তার সব সম্পদ একটি ট্রাস্টের অধীন রেখে সেটা থেকে মানবকল্যাণে যারা অবদান রাখবেন তাদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়ে যান।
মরণোত্তর পুরস্কার
১৯৭৪ সাল থেকে নোবেল ফাউন্ডেশন এক ঘোষণায় জানায়, এখন থেকে মরণোত্তর পুরস্কার নাও দেওয়া হতে পারে। তবে মনোনীত কোনো ব্যক্তি অক্টোবরে পুরস্কার ঘোষণা ও ডিসেম্বরে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি যেকোনো সময় মারা গেলে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে।
এই পরিবর্তন কার্যকর হওয়ার আগে দুজন মরণোত্তর নোবেল পেয়েছিলেন। তারা হচ্ছেন ডাগ হ্যামার্স্কোল্ড ১৯৬১ সালে শান্তিতে ও এরিক আক্সেল কারফেল্ড ১৯৩১ সালে সাহিত্যে।
তথ্যসূত্র: এনডিটিভি, এএফপি ও এনপিআর, দৈনিক যুগান্তর ।
অভিজিৎ ব্যানার্জি, নার্গিস মোহাম্মদি, কার্ল ভন ওজিয়েতস্কি, অং সান সু চি, লিও শাওবো ও আলেস বেইলিয়াৎস্কি। ছবি: সংগৃহীত