একজন গবেষক আনোয়ার শাহজাহান ও কয়েকটি গ্রন্থপাঠ : মাদক নয়, বই পড়া হোক নেশা
মুহাম্মদ শাহেদ রাহমান
:::
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া ও আবিস্কারের মাধ্যমে সৃষ্টিশীল নতুন কিছু সমাজ ও জাতিকে প্রদান করাই হচ্ছে গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া গবেষণার মূল লক্ষ্য হচ্ছে- বাস্তবিক কোন সমস্যার শুদ্ধ, সুন্দর, গ্রহণযোগ্য সৃজনী সমাধান খুঁজে বের করা ।
লেখার শুরুতেই গবেষণার কথা বললাম কারণ বিশ্বব্যাপী করোনাকালীন এই বৈরী সময়ে আমরা সবাই একপ্রকার গৃহবন্দি জীবনযাপন করছি। আমার এই দীর্ঘ গৃহবাসকালিন সময়ে ডাকযোগে কিংবা সরাসরি অনেকখানা বই উপহার পেয়েছি— শুভাকাঙ্খীদের কাছ থেকে। এগুলোর দুএকটি সম্পর্কে পড়ে যদি কিছু না লিখি , তখন নিজেকে অকৃতজ্ঞ মনে হবে।
করোনাকালিন সময়ে আমার কিছু গ্রন্থপাঠের প্রবাসী একজন গবেষকের প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থ সম্পর্কে ও লেখক পরিচিতি সম্পর্কে সুপ্রিয় পাঠকদের একটু চুম্বক ধারণা দেব।
আর এই ভাল বই গুলো পড়লে বা সংগ্রহ করলে আপনারাও আরো বেশি জানতে পারবেন, বুঝতে পারবেন এবং এসব মৌলিক- গবেষণা গ্রন্থ থেকে জ্ঞানার্জন করতে পারবেন।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী গবেষক, লেখক, সাংবাদিক আনোয়ার শাহজাহান ও তাঁর প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থ সম্পর্কে পড়ে কিছুটা হলেও লিখছি— যা আমার কাছে ভাল মনে হচ্ছে। তার আগে গবেষক আনোয়ার শাহজাহান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরছি।
আনোয়ার শাহজাহান :
যাঁরা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সাধনা —- গবেষণা আর ত্যাগের সংগ্রামে নিয়োজিত তাদেরই একজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক, গবেষক, সাংবাদিক আনোয়ার শাহজাহান।
জন্ম — সিলেট জেলার ঐতিহ্যবাহী গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। লেখালিখি শুরু সেই শৈশব – যৌবনকাল থেকে এখনো লিখে যাচ্ছেন অহনির্শী।
দেশে থাকাকালীন সময়ে ৯০ দশকের শুরুতে ’ মাসিক জনতার মিছিল’ সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি একজন সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পাশাপাশি তখন থেকে গোলাপগঞ্জের সাংবাদিকতায় অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯৫ সালে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের লক্ষ্যে এই বিলেতে আসেন মাতৃভূমি ছেড়ে । তবে লেখকের হৃদয়ে ছিল মা, মাটি এবং প্রিয় বাংলাদেশের কৃষ্টি- সংস্কৃতি। তাইতো এই বিলেতে এসেও থেমে নেই লেখক আনোয়ার শাহজাহানের লেখালেখি, গবেষণা ও সাংবাদিকতা । এই প্রবাসে এসেও তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ পাঠকদের উপহার দিয়েছেন।
তম্মদ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য , প্রথম প্রকাশ ১৯৯৬।
মধ্যাহ্নের কোলাহল ( কাব্য সংকলন ১৯৯৪), ক’জন কৃতিসন্তান ( জীবনীগ্রন্থ ১৯৯৫) , সময়ের শ্রেষ্ঠ ছড়া ( ছড়াসংকলন ১৯৯৫), বিলেতের দিনগুলি অন্যান্য প্রসঙ্গ ( প্রকাশ ১৯৯৬)।
তাছাড়া আনোয়ার শাহজাহানের
আরেকটি উল্লেখযোগ্য সৃজনীকর্ম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দুইখন্ডের গবেষণা গ্রন্থ— “ স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১ম খন্ড ( প্রকাশ ২০১৬) “ এবং “ স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, ২য় খন্ড” ( প্রকাশ ২০১৭)।
বাংলাভাষা ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় তার একটি বই বেরিয়েছে। নাম হলো – Gallantry Award recipient freedom fighters of Sylhet .
লেখক আনোয়ার শাহজাহানের সম্পাদনায় “ প্রজন্মের সেতু “ নামক একটি সৃজনশীল স্মারক পাঠক শুভার্থীরা হাতে পেয়ে প্রশংসা করেছেন। তিনি অনেকগুলো ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করেছেন। যেগুলো পাঠ করে পাঠক সমাজ উপকৃত হয়েছেন—- ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সম্পর্কে আরো গভীরভাবে জানতে পেরেছেন। নি:সন্দেহে এরকম উদ্দোগ ও প্রকাশনা আলোকিত সমাজ গঠনে সৃজনী ও নান্দনিক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক আনোয়ার শাহজাহানের গবেষণা গ্রন্থ ও সাহিত্যকর্ম :
ঢাকা থেকে প্রকাশিত লেখক আনোয়ার শাহজাহানের স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১ম খন্ড এই গ্রন্থটি পাঠ করে মনেহলো অনেক তথ্যবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ বই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে আগামী প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে এই গ্রন্থটি পাঠে।
এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে তথ্যবহুল কথা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের
জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব। এই ৭ মহান বীরশ্রেষ্ঠদের নাম অনেকেই জানেন। না জানলেও এইবইটি পড়ে আরো অনেককিছু জেনে নিতে পারবেন।
৭ বীরশ্রেষ্ঠ হলেন- বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান , বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর,
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ও বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ।
এই বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে ৬৮ জন বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্ত
মুক্তিযোদ্ধাদের নানাকথা ।
তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে ১৭৫জন বীর বিক্রমের যুদ্ধকালিন স্মৃতিকথা ও পরিচিতি ।
এই বইটির দ্বিতীয় খন্ড পাঠ করে জানতে পারবেন ৪২৬ জন বীরপ্রতীক স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি ও যুদ্ধকালিন কথা । জাতির শ্রেষ্ঠ
সন্তান চেতনার উৎস, মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনেক তথ্যবহুল কথা ও জীবনগল্প খুঁজে পাবেন এই গ্রন্থটি পাঠ করে।
তার এই লিখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক গবেষণাধর্মী— দেশে বিদেশে বাঙালি জাতির প্রাণ শক্তিকে চিরকাল জাগ্রত রাখবে ।
গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য:
লেখক আনোয়ার শাহজাহানের সম্পাদনায়
স্থানীয় ইতিহাস ঐতিহ্যের ইতিকথায় সমৃদ্ধ এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে । তারপর সংস্করন হয়েছে ২০১৫ সালে ঢাকা থেকে ।
মূল্যবান এই গ্রন্থে লেখক গোলাপগঞ্জের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বরণ্যে ব্যক্তিত্বের জীবন গল্প, সাহিত্য সাংবাদিকতা, ধর্মকথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা, নানা সংগ্রাম আন্দোলনের কথা, পর্যটনে গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন তথ্য অন্বেষণ , গবেষণা ও সম্পাদনার মাধ্যমে নান্দনিক উপস্থাপন এই গ্রন্থটি। ৩৮৪ পৃষ্ঠার এই বিশাল স্থানীয় ইতিহাস – ঐতিহ্যের বইটি পাঠ না করলে গোলাপগঞ্জের অনেক কিছু জানতে পারবেন না। জানতে পারবেন না স্থানীয় ইতিহাস সংস্কৃতির গহিনের কথা। এরজন্য দেশে বিদেশে সুপ্রিয় পাঠকদের বইটি সংগ্রহ করে একবার হলেও গোলাপগঞ্জকে জানার জন্য পড়া উচিত।
যে কোন ব্যক্তি অবকাশ পেলেই ভাল বই পড়া উচিত । হাঁটলে যেমন শরীর সুস্থ্য থাকে , দৌঁড়ালে আয়ু বাড়ে। অনেকগুলো রোগ থেকে সুস্থ্যতা মেলে । তেমনি জ্ঞানার্জন আর মনের
সুস্থ্যতার জন্য বই পাঠের বিকল্প নেই। কারো কাছ থেকে বই এনে বা বই কিনেও বই পড়ুন । বই কিনে আপনি এমন কোন অর্থ সংকটের মুখোমুখি হবেন না , এমনকি ঋণখেলাপীও হবেন না। তাই বই পড়ুন , একটি ভাল বই হোক আপনার নিত্যসঙ্গ।
শেষ কথা হলো বই পড়ুন, আর খেলাধুলা করুন—-এ সবই শরীর মনের জন্য উপকারী । শুধুমাত্র মাদককে না বলুন । মাদকের নেশা থেকে দূরে থাকুন । আগামী তরু-যুবসমাজকে রক্ষা করুন ।
মাদক নয়, বই পড়া হোক নেশা।
লেখক:
মুহাম্মদ শাহেদ রাহমান
সাবেক অধ্যক্ষ : সৈয়দপুর আদর্শ কলেজ। সুনামগন্জ ।