এসকেএম আশরাফুল হুদা, জগন্নাথপুর টাইমস ডেস্কঃ
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরায় স্কটিশ পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিরসনের উপায় খুঁজতে, বাংলাদেশ বিষয়ক ক্রস-পার্টি গ্রুপ (সিপিজি) এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আয়োজন করে। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব কমাতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান বক্তারা।
সম্প্রতি স্কটিশ পার্লামেন্ট সদস্য এমএসপি ফয়সাল চৌধুরী ও মাইলস ব্রিগস-এর উদ্যোগে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকটজনিত চলমান মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ম্যানচেস্টারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার মোহাম্মদ জোবায়েদ হোসেন, যিনি সদ্য নিযুক্ত হাইকমিশনার আবিদা ইসলামের পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন।
ভায় স্কটিশ বাংলাদেশি প্রবাসী কমিউনিটির বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি, শিক্ষার্থী, স্থানীয় কাউন্সিলর, ইউরোপ বাংলাদেশি ফেডারেশন, নর্থ ইস্ট বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন (NEBA), উদ্যোক্তা এবং স্টার্লিং, ডান্ডি, এডিনবরা, স্ট্রাথক্লাইড ও নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদরা অংশগ্রহণ করেন।
বক্তব্যে মো. জোবায়েদ হোসেন বাংলাদেশে চলমান রোহিঙ্গা সংকটের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে বিগত আট বছরে বাংলাদেশি স্বাগতিক জনগণের ওপর ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে।
ভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে অ্যাকশনএইড ইউকে-র ইনোভেশন ও রিসোর্স মোবিলাইজেশন পার্টনারশিপ বিভাগের প্রধান মারুফ মোহাম্মদ শিহাব জানান, ২০২৪ সালেই কক্সবাজারে তাদের সংস্থা ৯ লাখের বেশি মানুষকে সহায়তা দিয়েছে। এসব সহায়তার মধ্যে ছিল নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, যুব ক্ষমতায়ন, জরুরি আশ্রয় প্রদান, স্বাস্থ্যবিধি কিট বিতরণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা।
তবে মোহাম্মদ শিহাব সতর্ক করে বলেন, বর্তমানে তহবিল সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০২৫ সালের যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার (জেআরপি) জন্য এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৩ শতাংশ অর্থায়ন হয়েছে। ফলে নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ স্থান, শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি আরও জানান, এই সংকট সহিংসতা উসকে দিচ্ছে এবং শরণার্থী ক্যাম্পের সামাজিক সহনশীলতা ভেঙে দিচ্ছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) লন্ডন অফিসের পরিচালক জেরালডিন ও’ক্যালাঘানও একটি উপস্থাপনার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি জানান, তহবিল ঘাটতির কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খাদ্য রেশন কড়াকড়িভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে অনেক শরণার্থী অপুষ্টি ও অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বর্তমানে কক্সবাজারে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে এবং ভাসানচরে অবস্থান করছে আরও ৩৫ হাজার। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে এ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত নতুন করে আরও ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যা ইতোমধ্যে সংকটগ্রস্ত মানবিক কাঠামোকে আরও চাপে ফেলেছে।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাসের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে ইউএসএইড (USAID) এর অনুদান হ্রাসের ফলে শিশুদের খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা সহ অন্যান্য মৌলিক সেবা হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানান বক্তারা।
বৈঠকে এমএসপি ফয়সাল চৌধুরী ও মাইলস ব্রিগস তাদের ২০২৩ সালের কক্সবাজার সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তারা বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের ভয়াবহতা সরেজমিনে দেখেছেন এবং টিকাদান ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়া, তারা আন্তর্জাতিক সহায়তা আরও জোরদার করার আহ্বান জানান।
ফয়সাল চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট যেন ভুলে না যাওয়া হয়, তা নিশ্চিত করতে আমরা সিপিজির মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করছি। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই সংকট ও আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি, বিশেষ করে যখন তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা হুমকির মুখে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সহকারী হাইকমিশনারের কাছ থেকে পরিস্থিতির বিস্তারিত জানতে পারা ইতিবাচক। আমরা স্কটল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে একসঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। এতে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা, জলবায়ু সহনশীলতা, শিক্ষা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এগিয়ে যাবে। সিপিজি একটি অর্থবহ সংলাপ ও অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নিউক্যাসলের সাবেক লর্ড মেয়র কাউন্সিলর রহমান হাবিবও। তিনি যুক্তরাজ্যে প্রথমবারের মতো একটি রোহিঙ্গা স্মৃতিস্তম্ভ ‘রোহিঙ্গা মেমোরিয়াল স্টোন’ নির্মাণের ঘোষণা দেন, যা ব্র্যাডফোর্ডে স্থাপন করা হবে। এই স্মৃতিস্তম্ভ রোহিঙ্গা জনগণের দুঃখ-কষ্ট ও সংগ্রামের স্মারক হিসেবে বিবেচিত হবে। সিপিজি’র আহ্বায়ক ফয়সাল চৌধুরী এবং মাইলস ব্রিগস ২৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখে স্মৃতিস্তম্ভ উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
বৈঠকের শেষভাগে স্কটল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের পক্ষ থেকে যুব নেতৃত্ব, শিক্ষা ও জলবায়ু ন্যায়বিচার সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্যোগের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। বক্তারা জানান, এসব প্রচেষ্টা স্কটল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ অংশীদারিত্বের প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশ বিষয়ক ক্রস-পার্টি গ্রুপ স্কটল্যান্ডে বাংলাদেশি কমিউনিটির অধিকার, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং মানবিক সংকট বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবিচলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই বৈঠক থেকে আশা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকটের দিকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ফেরাতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।