পর্যটন অর্থনীতিতে অন্যতম জোগানদার খাত
ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক
২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) উদ্যোগে ১৯৮০ সাল থেকে পর্যটন বিকাশে বিশ্ববাসীকে সচেতন ও পর্যটনের উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের লক্ষ্যে সারা বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দিবসটি পালিত হয়। প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্যও নির্ধারণ করা হয়। logo অ্যান্ড গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট’ বা পর্যটনে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ। একটি নতুন পর্যটন বিনিয়োগকৌশল নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, রাষ্ট্রসমূহ, বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, উন্নয়ন সহযোগী, বেসরকারি খাতকে ঐক্যবদ্ধ করার তাগিদ দিচ্ছে এ বছরের দিবসটি।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পর্যটন অর্থনীতিতে অন্যতম জোগানদার খাত হয়ে উঠেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিবছর প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার অবদান রয়েছে পর্যটন খাতের। সব দেশই এ খাতের উন্নয়নে কোনো না কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে, নতুন নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। তবে অনিয়ন্ত্রিত ও ভঙ্গুর পর্যটন কেবল সংশ্লিষ্ট দেশের জন্য নয়; বরং পুরো বিশ্বের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অটেকসহ (আনসাসটেইনেবল) পর্যটন প্রতিবেশ ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ সংকট ডেকে আনছে।
মূলত অর্থনীতিতে পর্যটনের সম্ভাবনা যেমন বহুমুখী; তেমনি সংকটও তেমনই। পর্যটনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে পরিবহন, আবাসন, বিনোদন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, স্থানীয় পণ্যের বাজার, কর্মসংস্থানসহ অর্থনীতির নানা খাত। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণায় উঠে এসেছে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য কেবল হুমকিস্বরূপই নয়; বরং জলবায়ূ পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া বিমান পরিবহন থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ সড়ক যাতায়াত, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিনোদন ও অবকাশযাপনকেন্দ্রে যে বিদ্যুৎ ও শক্তি ব্যবহৃত হয় এর মূল উৎস জীবাশ্ম বা ভূগর্ভস্থ জ্বালানি। এখানেই পর্যটনের পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কিত ঝুঁকির ব্যাপারটি গভীরভাবে সম্পর্কিত। জীবাশ্ম জ্বালানির মূল উপাদান কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেলের ব্যবহার কেবল একবারই হয়ে থাকে এবং ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর কার্বন নির্গতের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে পুরো বিশ্বকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিয়েছে। এই জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ভাটিতে অবস্থিত দেশসমূহ সাগরের সঙ্গে মিশে যাওয়া উপক্রম। মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার মতো অনেক দ্বীপরাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। বাংলাদেশের অন্তত ২০ ভাগ ভূমি সাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশসমূহের পর্যটনশিল্পের একটি বিশেষ অংশ দ্বীপ, সাগর, নদী ও উপকূলকেন্দ্রিক পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। যদি এসব উপকূলীয় এলাকা সাগরের সঙ্গে মিশেই যায় তাহলে এই রাষ্ট্রগুলোর পর্যটন বলতে কোনো কিছু থাকবে না।
বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা, কক্সবাজার ও সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প কি কল্পনা করা যায়? বাস্তবতা হচ্ছে—অনিয়ন্ত্রিত ও দায়িত্বহীন (আনকনট্রোলড অ্যান্ড ইরেসপনসিবল) পর্যটন গড়ে ওঠায় পর্যটকরাও ময়লা-আবর্জনার ব্যাপারে সচেতন না। স্থানীয় পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিনষ্ট করে পর্যটন গড়ে উঠতে পারে নন। যেমন আমাদের সেন্টমার্টিন, জাফলং, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ নানা পর্যটনকেন্দ্রের চিত্র দেখলেই অনুধাবন করা যায় দায়িত্বজ্ঞানহীন পর্যটন কীভাবে এসব এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে। ইকো ট্যুরিজমের নামে রাতারগুল, লাউয়াছড়া, রেমা-কালেঙ্গা, সুন্দরবন, সাতছড়ির জীববৈচিত্র্য আজ অস্তিত্বসংকটে। পর্যটনের নামে হাওরের বুক চিরে আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ শেষ করে এখন সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীই বলেছেন, আমাদের ভূপ্রকৃতিতে কুড়াল মারা হয়েছে। হয়তো এই প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা দিয়েছেন হাওরে আর আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করা হবে না। অথচ পর্যটন ও যোগাযোগ উন্নয়নের নামে যখন এসব সড়ক নির্মাণ করা হয় তখন পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদকে বাঁকা চোখে দেখা হতো ও এখনও ক্ষেত্রবিশেষে হয়। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন আসছে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পর্যটন খাতে এখন পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা মুখ্য হয়ে উঠেছে।
মূলত পর্যটন খাত অনিয়ন্ত্রিত ও দায়িত্বহীন হলে বহুমুখী সংকটের সৃষ্টি হয়। এর মূল প্রভাব পড়ে জলবায়ু ও পরিবেশের ওপর। যেহেতু গতানুগতিক নিরাপত্তাব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে জলবায়ু ও পরিবেশগত নিরাপত্তা প্রতিটি দেশের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটি একটি অগ্রাধিকার খাত। তাই গ্রিন ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন রাজনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গেও জড়িত। পরিবেশবান্ধব পর্যটন হলেই চলবে না; পর্যটন খাতের সব বিনিয়োগও হবে পরিবেশবান্ধব। কার্বন নিগর্মন কমাতে হবেই ও পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যাবে না। গুরুত্ব দিতে হবে অন্তত পর্যটনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার শুরু করে দেওয়ার ওপর।
পরিবেশবান্ধব পর্যটন নতুন কোনো ধারণা নয়। আজ থেকে দুই দশক আগে জাতিসংঘ ২০০২ সালকে ইকো-ট্যুরিজম বর্ষ হিসেবে পালন করে। তবে ইকো-ট্যুরিজম ও পরিবেশবান্ধব পর্যটনে ধারণা ও ব্যাপ্তিগত পার্থক্য রয়েছে। ইকো-ট্যুরিজম পর্যটনের একটি উপাদান, যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা বন-প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের সৌন্দর্য অবলোকন করতে ভ্রমণ। পরিবেশগত ও সংস্কৃতিগতভাবে টেকসই এ পর্যটনে প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে স্থানীয় হিস্যা নিশ্চিতের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বিগত দুই দশকে রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক ধারণাই হালনাগাদ করা হয়েছে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। সাম্প্রতিককালে বেশিরভাগ ধারণা ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি বা আন্তঃবিষয়ক। এ ছাড়া পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি যেহেতু আমাদের অস্তিত্বের তথা পৃথিবী টিকে থাকবে কি থাকবে না, এ বিষয়টির সঙ্গে জড়িত তাই সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির অনেক ধারণার সঙ্গে পরিবেশকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
পর্যটন হলো বৈশ্বিক উন্নয়নের অন্যতম স্তম্ভ। আর উন্নয়নের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পরিবেশ ও জলবায়ু সংবেদনশীলতা। একটা সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেই তাকে উন্নয়ন বলা হতো। এখন সে উন্নয়ন ধারণা থেকে বিশ্ব বেরিয়ে এসেছে। এখন উন্নয়ন বলতে বোঝায় টেকসই উন্নয়ন। অর্থাৎ আগামী প্রজন্মের জন্য বসবাসযোগ্য বিশ্ব নিশ্চিত করে বর্তমান উন্নয়নসাধন করা এবং পর্যটন এর বাইরে কিছু নয়। পর্যটনে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ করতে হবে আগামীর প্রয়োজন পর্যটনশিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য। এটাই হলো টেকসহ পর্যটন বা সাসটেইনেবল ট্যুরিজম।
লেখক: উপাচার্য, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট ও আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)