ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : শিক্ষা ও সমাজ চিন্তা- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
ভাষাচার্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (জন্ম ১০ জুলাই ১৮৮৫, মৃত্যু ১৩ জুলাই ১৯৬৯) সংস্কৃতকে দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে নিয়ে ১৯০৪ সালে হুগলি জেলাস্কুল থেকে ‘এন্ট্রান্স’ (বর্তমান মাধ্যমিক পরীক্ষা), ১৯০৯ সালে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে বিএ (অনার্স), ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এমএ এবং ১৯১৪ সালে এলএলবি পাস করেন। ১৯২৬-২৮ পর্যন্ত প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈদিক ভাষা, প্রাচীন পার্সি, তিব্বত, বিভিন্ন আধুনিক ভারতীয় ভাষা অধ্যয়ন ও পিএইচডি অর্জন, উপরন্তু ডিপ্লোফোন সনদপত্র লাভ করেন। ১৯২৭-২৮ এ সরবনে পাঠরত অবস্থাতে এক অবকাশে জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈদিক, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা অধ্যয়ন।
তিনি ১৯০৮-০৯ সাল পর্যন্ত যশোর জেলাস্কুলে শিক্ষকতা করেন।। ১৯১৫ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৫-১৯ সালে চব্বিশ পরগনার বশিরহাটে আইন ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিলেন। এ সময় স্থানীয় পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাকে তার যোগে জানান, শহীদুল্লাহ বার ইজ নট ফর ইউ, কাম টু আওয়ার ইউনিভার্সিটি। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শরৎকুমার লাহিড়ি গবেষণা সহায়ক পদে নিযুক্তি লাভ করেন। ১৯২১ সাল অবধি সে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯২১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ১৯২২-২৪ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে খণ্ডকালীন অধ্যাপনাসহ ১৯৩৭ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ পৃথক হলে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ও রিডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ এবং ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত ওই পদে অধ্যাপনা করেন। অবসর গ্রহণের পরপর বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যক্ষ পদের দায়িত্ব পান। ১৯৫৮ সালে শিক্ষকতার পেশা থেকে অবসর নেন তিনি।
২১টি ভাষার ব্যুৎপত্তি জ্ঞানসম্পন্ন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা একাডেমিতে ‘পূর্ব পাকিস্তানি আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত করেন। ইসলামিক একাডেমিতে ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি গঠিত ‘বাংলা পঞ্জিকার তারিখ নির্ণয় কমিটি’র সভাপতি হন। তার নেতৃত্বে ওই কমিটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিযুক্ত ব্যবহারিক বাংলা পঞ্জিকা প্রস্তুত করে, যা বর্তমানেও অনুসৃত হয়ে থাকে। গবেষণা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশুতোষ গ্রন্থসহ সঙ্কলন ও সম্পাদনা গ্রন্থ এবং পত্রপত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ছিলেন সুপরিচিত। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম ও প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ সহযোগে তিনি মিরপুরে বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আদমজী, দাউদ প্রভৃতি সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী সভাপতিরূপেও দায়িত্ব পালন করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের আরেকটি দিক হলো সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতিমূলক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সক্রিয় সম্পৃক্ততা। তিনি ছাত্রজীবনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সম্পাদক (১৯১১-১৫) হন; তিনি দ্বিতীয় দফায় যুগ্ম সম্পাদকের (১৯১৮-২১) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা’ নামক একটি ধর্মীয়-সামাজিক সংগঠনের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন (১৯১৭)। ১৯২৩-এর ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের সমাবর্তন উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। ছিলেন ১৯২৬-এর ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ আয়োজিত প্রতিষ্ঠা সভার সভাপতি। ১৯২৮ সালে কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম যুবক সম্মেলনের প্রথম এবং ১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪১-এ হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলনে ভাষাতত্ত্ব শাখার সভাপতি এবং ফিলোলোজি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান লিঙ্গুইস্টিকস প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৪২-এ ঢাকায় ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ আয়োজিত সোভিয়েত মেলা নামের চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে পূর্বপাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। মাদ্রাজে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন ট্রাডিশনাল কালচার ইন সাউথ ইস্ট এশিয়া’ অনুষ্ঠানে ইউনেস্কোর প্রতিনিধিত্ব করেন। তার চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে প্রাইড অব পারফরম্যান্স এবং ১৯৬৭-তে ফরাসি সরকার নাইট অব দ্য অর্ডারস অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স পদক প্রদান করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ধর্মীয় অনুভূতি অপেক্ষা জাতীয় অনুভূতিকে অধিক গুরুত্ব দিতেন তিনি। জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনা সম্পর্কে তার বক্তব্য : ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বেও এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই উক্তি বাঙালির জাতীয় চেতনা শাণিতকরণে মাইলফলকের ভূমিকা পালন করে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৯৪৭) পরপর দেশের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে, না বাংলা হবে এ বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি। তার এ ভূমিকায় পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে শহীদুল্লাহ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে লেখনীর মাধ্যমে ও সভা-সমিতির বক্তৃতায় জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করে আন্দোলনের পথ প্রশস্ত ও গতি বৃদ্ধি করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ড. জিয়াউদ্দীন উর্দু ভাষার পক্ষে ওকালতি করলে ড. শহীদুল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর প্রতিবাদ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার পক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবল বৈজ্ঞানিক শিক্ষানীতির বিরোধীই নহে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতিবিগর্হিতও বটে।’ (পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা, দৈনিক আজাদ, ১২ শ্রাবণ ১৩৫৪)।
তিনি একজন সুযোগ্য পণ্ডিত এবং অর্ধশতাব্দীকাল শিক্ষক হিসেবে কাটিয়েছেন। শিক্ষা সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছিল সুদূরপ্রসারী। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে হয়তো এটি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন যে, যে জাতির শিশুসাহিত্যের গতি গঠনমূলক নয় এবং শিশুশিক্ষার সহকর্মী নয় যে জাতির বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও শিক্ষার প্রসার কোনো মতে সম্ভব নয়। শিশুর সুশিক্ষা এবং ন্যায়নীতিনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদাবোধের সুকুমারবৃত্তিগুলো বিকশিত হওয়ার মতো ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে না পারলে ভবিষ্যতে কোনো কল্যাণকর কিছু তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। শিশুদের সুকুমারবৃত্তি প্রস্ফুটনের ক্ষেত্র হলো শিশুসাহিত্য।
বলাবাহুল্য, আমাদের শিশুসাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য তার সচিত্র মাসিক পত্রিকা আঙুরের কথা অনেকে শুনে থাকবেন। আমাদের তৎকালীন সমাজে এই আঙুর প্রথম এবং একমাত্র কিশোর পত্রিকা। অবশ্য এর আগে ‘সন্দেশ’ ও ‘মৌচাক’ নামে আরো দু’টি কিশোর পত্রিকা ছিল কিন্তু আঙুরের মতো সন্দেশ ও মৌচাক তেমনিভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি কিশোর সমাজকে। যদিও বাংলার আর্দ্র আবহাওয়ায় ‘আঙুর’ বেশি দিন বাঁচেনি (১৩২৭ বাংলা সালের বৈশাখ থেকে ১৩২৮ সালের জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত)। তবু এ স্বল্পকাল আঙুরের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এ পত্রিকাতে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, ডাক্তার আব্দুল ওয়াহেদ, অধ্যাপক আলী আহমদ প্রমুখ। এ পত্রিকার প্রচ্ছদে থাকত আঙুরের গাছ এবং থলি থলি আঙুর। আঙুরের লোভে ছেলেমেয়েরা চার দিকে মাতালের মতো ঘোরাফেরা করছে। তিনি ছিলেন এ পত্রিকার সম্পাদক।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যে বিশাল জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন তা তাকে গোঁড়ামি অথবা অহঙ্কারী করে তোলেনি; বরং এ বিশাল জ্ঞানরাজি তাকে দান করেছিল এক সুমহান ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু নিজ ধর্ম ইসলাম চর্চা করেননি অথবা আপন ধর্মে নিজেকে সঁপে দিয়ে অন্ধত্ব বরণ করেননি। অপরের ধর্মীয় পুস্তকাবলি পাঠ ও চর্চা করে তিনি দেখিয়ে গেছেন ধর্ম মানুষকে বেঁধে রাখতে পারে না; বরং ধর্ম মানুষকে দিয়েছে মহত্তম মুক্তি।
‘যেসব অবিবাহিত লোক সন্ন্যাসী হয়ে তাদের নামের সাথে ‘স্বামী’ এই বিশেষণ যোগ করে দেয়, যেমন দয়ানন্দ স্বামী, সদানন্দ স্বামী ইত্যাদি, আমি তাদের মতো স্বামী নই। আমার স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আমি তাদের মতো স্বামী। আমার নাম জ্ঞানানন্দ স্বামী, জ্ঞানচর্চায়ই আমার আনন্দ।’ কথা কয়টি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয়বার অবসর গ্রহণকালে সংবর্ধনা সভায় বলেছিলেন। রসিকতা করে কথা ক’টি বলা হলেও এর ভেতর নিহিত আছে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কে চিরন্তন সত্য কথা। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন এমন একজন জ্ঞানসাধক যিনি আজীবন ওই সাধনায় একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত ছিলেন। প্রায় পৌনে এক শতাব্দীকাল ধরে অক্লান্তভাবে তিনি জ্ঞানচর্চা করে গেছেন। তিনি জ্ঞান সাধনায় এই যে অসাধারণত্ব অর্জন করেছিলেন তার জন্য তিনি কোনো দিন অহমিকা দেখাননি। তিনি ছিলেন শিশুর মতো সরল। হিংসা, ঈর্ষা, অহঙ্কার কোনো দিন তার চরিত্রে ঠাঁই পায়নি। তিনি প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল শিক্ষকতা করে কাটান। পাশাপাশি সমাজের প্রতি তিনি তার দায়-দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে ছিলেন সদা সচেতন।
লেখক : ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ , উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক