জগন্নাথপুর টাইমসবৃহস্পতিবার , ২৩ মার্চ ২০২৩, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অর্থনীতি
  2. খেলা
  3. গ্রেট ব্রিটেন
  4. ধর্ম
  5. প্রবাসীর কথা
  6. বাংলাদেশ
  7. বিনোদন
  8. বিশ্ব
  9. মতামত
  10. রাজনীতি
  11. ল এন্ড ইমিগ্রেশন
  12. লিড নিউজ
  13. শিক্ষাঙ্গন
  14. সাহিত্য
  15. সিলেট বিভাগ
 
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সৈয়দ হান্নান ও তাঁর রাজনীতি -এনামুল কবির

Jagannathpur Times Uk
মার্চ ২৩, ২০২৩ ২:২৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সৈয়দ হান্নান ও তাঁর রাজনীতি
::

এনামুল কবির:

প্রত্যেক ব্যক্তিই তার সমাজ-সংবেদ তথা প্রবণতার প্রতিনিধি। সৈয়দ আব্দুল হান্নানও এর বাইরের কেউ ছিলেন না; তাই আমরা দেখি- যুগের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন এবং এর মধ্যেই নির্মিত হয়েছে তাঁর চরিত্র। এখানে এটাও স্বীকার্য যে, সে নিরিখে কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্তি বা চরিত্রের বিচার অথবা মূল্যায়ন করতে হয়। আমাদের জানা যে, সৈয়দ হান্নান ছিলেন একজন রাজনীতির মানুষ এবং মৃত্যুবৎ তিনি তা-ই ছিলেন।

সৈয়দ হান্নানের জন্ম ১৯২৮ সালে, ১লা সেপ্টেম্বর; এখনকার- সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুরে। পিতা- শমসেদ আলীর ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। গ্রামেই তাঁর বেড়ে উঠা, প্রাথমিক পড়াশোনাও এখানকার মক্তবে; যৌবনে ছিলেন হবিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলেরও ছাত্র। রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা তাঁর তখন থেকে, এদিক থেকে বলতে হবে এর ব্যপ্তিটা বেশ বড়ই। অবশ্য তাঁর ভাসানীপূর্ব সময়ের কথা খুব বেশি জানা যায় না, এমন কী আসাম থেকে মাওলানার ফিরে আসার পরের কথাও নয়। তবে যখন আওয়ামী লীগ থেকে মাওলানা বেরিয়ে গেলেন এবং ৫৭ সালের দিকে পৃথক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেন- ন্যাপ, জানা যায় তখন থেকে তিনি হলেন এর কর্মী এবং তাঁর এলাকার একজন বড় নেতাও। কালক্রমে তখনকার যা সিলেট জেলা, আজকের একটা বিভাগ- এর সবখানে ব্যপ্ত হয় তাঁর লড়াই-সংগ্রামের কাহিনী। এভাবে ছোট একটা এলাকা থেকে একসময় বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম ও সুনাম- দুইই। আর কে না জানে ৭০পূর্ব ন্যাপ ছিলো তুমুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন এবং মর্যাদা ও প্রভাবের দিক থেকেও সেটা কম ছিলো না। এরকম একটা সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্বদান ছিলো অবশ্যই শ্লাগার। আমরা দেখি- তখন ন্যাপের একাংশ, মোজাফফর- নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তিনিও হন এর প্রার্থী, কিন্তু নির্বাচনে জোয়ারটা ছিলো আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে; তাই তখনকার মতো পরাজিত হন- হান্নান। দেশ এসে উপস্থিত হয় মুক্তির দ্বারপ্রান্তে। তিনি তখন রাজনৈতিক সংগঠন বা গণ-অন্দোলনেই নয় আর, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও পালন করেন তাঁর ঐতিহাসিক দায়।

আমরা জানি, আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে উত্থাপিত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে যায় এবং জন্ম হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপের। এখানে উপদলীয় এক অংশের নেতৃত্ব তখন দিচ্ছিলেন মাওলানা ভাসানী, মূলত তাঁর নেতৃত্বে যখন ৫৬ সালের দিকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী কমিউনিস্টরা এই সম্মেলনে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি উত্থাপন করে, স্বভাবত অপর অংশ সেটা মেনে না নেওয়ায় এই প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটি হয় এবং লক্ষণীয় রূপে সেটা বিপুল ভোটে বাতিলও হয়ে যায়। বলা বাহুল্য এটা ছিলো শহীদ সোহরাওয়ার্দি পক্ষেরই জিৎ। তবে মাওলানার অহমের জন্য এটা ছিলো বেশ বেদনা বা হতাশার। ফলে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে তিনি গড়ে তোলেন ন্যাপ। তখনকার আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের মতো তিনি হলেন এরও প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। এখানে আওয়ামী লীগের মতো ন্যাপও হলো বুর্জোয়া পার্টিই, সৈয়দ হান্নান হলেন প্রতিষ্ঠাকালীন এই ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। দুটো সময়ে এখানে কমিউনিস্টদের জন্য অনুপ্রবেশ ছিলো কেবল একতরফা- এক অভয়ারণ্য! কিন্তু ৫৭ থেকে ৬৫- খুব বেশি সময় নয়, আমরা এখানে দেখি এর মধ্যে ন্যাপ এক থাকেনি; সমাজতন্ত্রের আন্তর্জাতিক শিবিরের দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে কেন্দ্র করে সেও ভেঙ্গে যায়। মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী- এই দুই ধারা বা শিবিরে ভাগ হয়ে যায় ন্যাপের সাধারণ নেতাকর্মীরাও। মাওলানা তখন চীনপন্থীদের নেতা, চীনের নেতা হলেন মাও; তাই মাওয়ের কথা, ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ তাঁকেও মেনে নিতে হয়। এখানে এসেই ন্যাপ ভেঙ্গে যায়, মস্কোপন্থীদের নেতৃত্ব দেন তখন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। ৬৭ সালে তাঁর নেতৃত্বেই মস্কোপন্থীদের নিয়ে তিনি গঠন করেন এই ন্যাপের অপর অংশ এবং তিনি নির্বাচিত হন এর সভাপতি। উল্লেখ্য যে, সৈয়দ হান্নান ছিলেন এই ন্যাপ (মোজাফফর) এর শুরু থেকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং একটা সময় থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সিলেট শাখার সভাপতি ও একমাত্র নেতা।
অবশ্য গণসংঠনের ভীতটা তাঁর অগেই থেকেই রপ্ত হয়ে গিয়েছিলো, সেটা- ৫৩ তে, যখন প্রগতিশীল গণতন্ত্রী দল গঠিত হলো আর তিনি হলেন এর সুনামগঞ্জ মহকুমা শাখার সদস্য। এখানে দ্বিতীয় পর্বটা ছিলো তাঁর ন্যাপের রাজনীতি- বলাই বাহুল্য। আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন ভাসানী, যখন পাকিস্তান হলো, তিনিও চলে এলেন এখানে। অল্পদিনের মধ্যে হয়ে উঠলেন মুসলিম লীগের বড় নেতা। পরবর্তীতে যতই ব্যর্থ হোন, তাঁর সা¤্রাজ্যবাদ থেকে সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ থেকে সাম্প্রাদায়িকতা বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাস ও মর্যাদা একটু ক্ষুণœ হয় না। এখানে সৈয়দ হান্নান কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেননি, এদিক থেকে বলা একটু কঠিন ৪৯-এ যখন মাওলানা আওয়ামী লীগ গঠন করেন, তখন তাঁর সান্নিধ্যে তিনি এসেছিলেন। যদি তাই হয়, তা হলে যতদূর সম্ভব এটা হবে ৫২ সালের পরেই, যখন ভাষা আন্দোলন রাজনীতিতে একটা অনকুল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এর ফলেই শ্রমিক আন্দোলনেরও বিস্তার হয়, পাট শিল্পের বিকাশের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় আদমজী পাটকল এবং তখনকার মতো পাটকল মজদুর ইউনিয়নও। মাহমুদ আলী সুনামগজ্ঞের মানুষ, তখন যুবলীগের সভাপতি, তিনি কমিউনিস্টদের সহযোগীও বটে, হলেন- এই মজদুর ইউনিয়নের সভাপতি; কমরেড দেওয়ান মাহবুব আলী হন এর সম্পাদক। ৫৪তে আদমজী পাটকল মজদুর ইউনিয়নের সভাপতি হন ভাসানী, যতদুর সম্ভব- হান্নান ছিলেন এই কমিটিতে এবং তিনি এর সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

কিন্তু শাসকগোষ্ঠী সম্মিলিত জনগণের শক্তিকে ভয় পায়, কেননা সম্মিলিত জনগণই হলো ইতিহাসের নির্মাতা; তাই তারা সচেষ্ট হয় কীভাবে জনগণের এই শক্তি বা সংগঠনকে ভেঙ্গে দেওয়া যায়। তারা সে চেষ্টাই করে, এখানে তাদের লক্ষ্য ছিলো দুটি- কেবল হক মন্ত্রীসভার পদচ্যুতিই নয়, আদমজী পাটকল মজদুর ইউনিয়ন ভেঙ্গে দেওয়াও। সেটা কী করে করা যায়? অতএব দাও লাগিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বাঙালি-বিহারী দাঙ্গা! তখন মার্কিন চক্রান্তের সঙ্গে সফল হয় পাকিস্তানী শাসকচক্রও। যুক্তফ্রন্ট সরকারের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্ভাগ্য, এবার কেন্দ্র থেকে জারি করা হলো ৯২(ক); মজদুর ইউনিয়নের যারা নেতৃবৃন্দ ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে বাদ যান না সৈয়দ হান্নানও। তখন ২৭ দিনের মতো তাঁকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে থাকতে হয়, জামিন পেলেও ৫৬ এর আগে আর মামলা থেকে তাঁর মুক্ত হওয়া হয়নি। রাজনীতিতে যে সাহস ও দৃঢ়তার প্রয়োজন, এটা তাঁর ভালোই ছিলো; স্বভাবত যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক, এর অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে তিনি লক্ষ্যভেদী বেড়ে উঠতে পেরেছিলেন। এখানে তাই রাজনীতিটা তাঁর ভেতর থেকে শেখা হয়ে গিয়েছিলো। বস্তুত সৈয়দ হান্নান ছিলেন একজন তীব্র রাজনীতি সচেতন মানুষ। জাতীয় থেকে এতদঞ্চলের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও লড়াই-সংগ্রামে তিনি ছিলেন সামনের সারির। আমরা দেখেছি- প্রতিটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে তাঁর অবস্থান ছিলো আন্তরিক দেশপ্রেমিকের। পরবর্তীতে যখন পাটকল থেকে বিতারিত হয়ে গ্রামে ফিরে আসেন, কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে শুরু করেন কাজ, শুধু কৃষক সমিতিই নয়, তখন প্রতিষ্ঠা করেন পাওয়ার পাম্প সমিতিও। আর এর প্রতিদানও পান তিনি, স্বাধীনতা-উত্তর সময়- ৭৭ সালে, তিনি নির্বাচিত হন সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ৭৮ সালে শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান পুরস্কারও পান।

এই কিংবদন্তী মানুষটি, প্রয়াত হন ৩১ আগস্ট, ২০২১খ্রি.তে; দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। শুনেছি, এই সময়টা ছিলো তাঁর বেশ নিঃসঙ্গতার। তাঁর এই মৃত্যুতে শেষ হলো কঙ্কালসার ও কুঁড়েঘরের অধিকারহীন মানুষের সংগ্রামের একটা অধ্যায়। সৌভাগ্যই বলতে হবে আমি এই মানুষটির সঙ্গে একসময় কিছুটা জড়িয়ে গিয়েছিলাম। এখন এসব স্মৃতির সবটা বলা বেশ কঠিন, আমি মনে করি- এসব আমাদের উত্তরাধিকারের পথ কিছুটা চিহ্নিত করতে পারে। কীভাবে আমি মার্কসবাদী ন্যায়বোধে এসে পৌঁছলাম? সৈয়দ হান্নান মার্কসবাদী ছিলেন না, তবুও বলতে হবে এটা হলো সে দিকচিহ্নেরই একটা অংশ। তিনি জগন্নাথপুর আসতেন এবং হেমন্তে সেটা হতো সবসময় পায়ে হেঁটেই। উচ্চতায় এই মানুষটি ছিলেন গড়পরতা বাঙালির থেকে একটু আলাদাই, দেহ-সৌষ্ঠবে- অনেকটা যেনো খোদাই করা ভাস্কর্য; আর তাঁর গায়ের রঙ ছিলো বেশ ফর্সা- লাল। কথায় প্রণোদনা বা উৎসাহপূর্ণ ছিলেন, কিন্তু কথা বলতেন ভাঙ্গা স্বরে। দেখেছি সবসময় তাঁর পরনে থাকতো- সফেদ পায়জামা ও পাঞ্জাবি এবং সেটা হতো খদ্দেরের। পরবর্তীতে এমনটাও শুনেছি যে, এসব ছিলো প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদেরই পোষাক। তবে আজ আর মনে পড়ছে না অন্যরা এমন পোষাক খুব একটা পরতেন কি-না, এদিক থেকে বলতে গেলে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বলা বাহুল্য এসব তাঁকে সেসব দিন ভিন্নতর একটা সৌন্দর্য দান করেছিলো।

এখানে বলি- মিছিলে যাওয়াটা আমার বেশ আগেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো, এটা বেশ ছোটবেলাতেই, ৮৬ বা ৮৭ সালের দিকে হবে। (এই নিয়েও আমাকে একদিন কিছু বলতে হবে।) একটা বিরতির পর আরেকবার ৯০-এ, এরশাদ বিরোধী তথা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। অবশ্য এইসব দিনগুলিতে সৈয়দ হান্নানকে দূর থেকেই দেখি, পরিচয় ও ঘনিষ্টতা শুরু হয় আরও কিছুদিন পরে। তখন জগন্নাথপুরে তাঁর প্রভাবটা আর আগের মতো নেই। ১৯৮৬ বা ৮৭ সালের দিকে কোথাও যাত্রাগান না হবার দাবিতে তিনি জড়িয়ে পড়েন, বড়সড় সভা হয় স্বরূপচন্দ্র সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ! বেশির ভাগ আলেম-উলেমা। সভা পরবর্তী মিছিল জঙ্গিরূপ নিলে পুলিশ গুলি করে। মান্নান নামীয় একজন তখন নিহত হয়। এমনটা জগন্নাথপুর আর দেখেনি, দুপরের তপ্ত রোধ আর এ ঘটনায় তখন এখানকার মানুষ দিকশূন্য। স্বভাবত জগন্নাথপুরে আর সৈয়দপুরের প্রভাব সেরকম থাকেনি। কিন্তু তাতে কী! একটা সময় সৈয়দ হান্নান আবারও ফিরে আসেন তাঁর রাজনীতিতে। বর্ষায়- জগন্নাথপুর তখনও ভাটি, কাউকে রাজনীতি করতে হলে আগেরদিন এখানে এসে থাকতে হয়। এরকম এক সন্ধ্যায় সৈয়দ হান্নান আসেন আমার নানাবাড়িতে। মহাজন বাড়ির ক্ষয়িষ্ণুতা তখনও শুরু হয়নি। আমার এক খালুর ছোট ভাই, সৈয়দ মবশ্বির আলী; তিনি- সৈয়দপুরেরই মানুষ। যদিও বেশি কথা বলতেন, স¤ভবত এর মধ্যে ম্যাগনাপোলিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন, বলতে গেলে তিনি ছিলেন তখন তাঁর সেক্রেটারী। এর দৌত্যটা ছিলো আসলে তাঁরই। তারপর অনেকবারই তিনি এখানে এসেছেন, রাত্রিযাপন করেছেন; দিনেরবেলা বাজারে করেছেন জনসভা। কখনও ব্যারিস্টার বাড়ির পূর্বে, পুকুরপাড়ে- বসেছেন; উঁচুনিচু হলেও সবুজ ঘাসে বসতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। অন্যূন ৩০/৪০ জনের একটা জমায়েত, পেশায় তারা জেলেই হবে; কজনের হাতে আছে এরকম ফেস্টুনও- ‘লাঙল যার, জমি তার’, ‘জাল যার, জলা তার’। মনে পড়ছে, মুৎসুদ্দি ও মজুদদার নিয়েও ছিলো এর দু-একটি। যাক, এইসব রাতের বেলা তিনি হয়ে উঠেন আমার মামাদের একজন, ভাঙা গলা, তবুও গল্প বলাতে ক্লান্তি নেই। তখন নির্ভীক ও আত্মত্যাগের এসব ভাষ্যে টিকরে পড়তো তাঁর চিন্তার উদারতা ও আত্মবিশ্বাস। নেতৃত্বের এই একটা বড় গুণ। তাই এসব সংসর্গের রাতগুলি ছিলো আমার জন্য দিক-সঞ্চারী এবং প্রাণিতকর।

যদিও পরবর্তী সময়ে তাঁর চিন্তা-ধারার সঙ্গে একমত হওয়া ছিলো কঠিন, বিচারহীন- সেসব আমার জন্য মেনে নেওয়াও ছিলো কষ্টকর। তাই যোগাযোগটা কমেই আসছিলো। একদিন গোপেন্দ্র সমাজপতিকে বলেছিলেন, কবিরকে চিনো? (তাঁর কাছে এই ছিলো আমার ডাক নাম, কখনও- ভাগনা বেটা।) তাকে বলো আমাকে যেনো ফোন দেয়। জেলা শহর সুনামগঞ্জে যখন গোপেন্দ্র দা’র সঙ্গে দেখা, তিনি তা-ই বললেন। আমি অবাকই হই, তাহলে এতোদিন পরও তিনি আমাকে ভুলে যাননি! তাঁর কাছ থেকে নম্বারটা নেই, বলি- পরে ফোন দেবো। তিনি বলেন, আরে না, এখনই- আমার সামনে থেকে দিতে হবে। আমি তা-ই করি, মামা তাঁর বাসায় যেতে বলেন; কিন্তু যাওয়া হলো আর! দুই-তিন বছর আগে এই ছিলো তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা বলার স্মৃতি।

এখন সৈয়দ হান্নান শ্রেণিতে পেটি বুর্জোয়া, না বুর্জোয়া ছিলেন এটা আর বিবেচ্যে নয়। একটি খাদহীন সত্য হচ্ছে, তিনি ছিলেন গরীব ক্ষেত-মজুর ও শ্রমিকদের জন্য সমতাপূর্ণ পৃথিবী নির্দেশ করার মতো মানুষ ও নেতা- এটাই। তিনি এখন আমাদের মধ্যে নেই- সত্য, পরিণত- ৯৩ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন। এই ৩১ আগস্ট, ২০২২ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এখানে এসে আমরা এটা বলতে পারি, রাজনৈতিক ইতিহাস ও উত্তরাধিকার বলে যদি কিছু থাকে, তবে মুক্তবিশ্বের নির্মাতারা- এতদঞ্চলের আগামী প্রজন্ম সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে গভীর শ্রদ্ধায় তাদের স্মরণ করতেই হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল মহাবিদ্যালয়, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ।

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি।