গাজায় ধ্বংসস্তূপ, বিশ্ব বিবেক স্তব্ধ : ফিলিস্তিনিদের কী করার আছে
ব্রি. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.)
::
১৯৪৮ সালে জন্মের পর থেকেই ইসরাইল একটি আক্রমণাত্মক জাতি। হিসাব কষে তারা কথা বলে না। আমেরিকা, ইইউ, জাপান, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা-কাউকেই তোয়াক্কা করে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ইসরাইলকে ‘হার্ড স্টেট’ বলে সম্বোধন করে। তাদের মিলিটারি পাওয়ার ও কারিগরি দক্ষতা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোর ‘আরঅ্যান্ডডি’ ইসরাইলে অবস্থিত। সবচেয়ে দামি FMCG (Fast moving consumer Goods)-এর মালিক ইহুদি অর্থাৎ ইসরাইলি বা তাদের সমর্থকরা।
গাজা ও পশ্চিম তীরের শাসন : ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনে নির্বাচন হলে গাজায় হামাস বিপুল ভোটে জয়ী হয়। পশ্চিম তীরেও তারা ব্যাপক ভোট পায়। তবে সেখানে ইসরাইল মোটামুটি রক্ষক বলে পিএলও নেতা মাহমুদ আব্বাসকে অনেকটা ‘ক্রীড়নক’ হিসাবে ক্ষমতায় বসায়। তবে গাজায় চলে হামাসের মানবিক শাসন। হামাস নেতারা দুর্নীতিমুক্ত এবং পিএলও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্নীতিগ্রস্ত বলে বহুল প্রচারিত। হামাস নেতারা পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে চাইছেন। তারা এও জানেন, এজন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হবে। ১৯৪৮ সালের পর থেকে আজ অবধি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কখনো ইসরাইল মেনে নেয়নি, বরং একের পর এক ফিলিস্তিনিদের বসতি থেকে তাদের উৎখাত করেছে। এর মাধ্যমে তারা ইহুদিদের বাসস্থান, শিল্পকারখানা, কৃষিজমি বাড়িয়েছে। ফিলিস্তিন ১৯৪৮ সালে যে এলাকা নিয়ে বিস্তৃত ছিল, তা আজ এক-দশমাংশে নেমে এসেছে। ইসরাইল সরকার যখন ইচ্ছা তখন তাদের গ্রেফতার করছে, নির্যাতন করছে, জেলে ঢোকাচ্ছে, বাড়িঘর ভেঙে নিজ দখলে নিচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর কী ঘটেছিল : ৭ অক্টোবর হামাস ও ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সশস্ত্র দল গাজা এলাকা থেকে একযোগে ইসরাইলে আক্রমণ চালায়। ইসরাইলের অভ্যন্তরে এমন হামলা ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর প্রথম। হামাস ও ফিলিস্তিনের অন্যান্য সশস্ত্র দল এ অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’, আরবিতে ‘আমালিয়াত তুফান আল আকসা’। এ আক্রমণের প্রত্যুত্তরে ইসরাইল হামাসকে মানুষ নয়, পশু বলে উল্লেখ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিচ্ছে আমেরিকাসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। ফিলিস্তিনের পক্ষে এ যুদ্ধে, বিশেষত ৭ অক্টোবরের হামলায় অংশ নেয় আল কাশিম ব্রিগেড, আল কুদস ব্রিগেড, আল নাসের সালাহ আল দীন ব্রিগেড, আবু আলী মুস্তফা ব্রিগেড, আল আনসার ব্রিগেড, মুজাহেদী ব্রিগেড ইত্যাদি গ্রুপ। অন্যদিকে ইসরাইলের রয়েছে গোলান ব্রিগেড, নাহাল ব্রিগেড, গাজা ডিভিশন, ইসরাইল নেভি ও ইসরাইল এয়ার ডিফেন্স কমান্ড।
এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত (অক্টোবর থেকে জুন ২৪ পর্যন্ত) প্রায় ৩৭ হাজার ফিলিস্তিনি জীবন দিয়েছেন, ৭৫ হাজার আহত হয়েছেন। এর মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা এবং বেসামরিক ব্যক্তিই বেশি। আর পুরো গাজা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
ফিলিস্তিনিরা এত ক্ষয়ক্ষতি কেন মেনে নিচ্ছে : ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর ফিলিস্তিন অঞ্চল ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ইসরাইল তার বসতি স্থাপনের জন্য সারা বিশ্বের ইহুদিদের ইসরাইলে বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করছে। একদিকে ইসরাইলের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার বসতি, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের ঘুপচি ঘরের মধ্যে গাদাগাদি হয়ে বসবাস। তাদের বাড়িঘর করতেও ইসরাইলের অনুমতি নিতে হয়। ফিলিস্তিনিদের চলাচল ইসরাইল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাদের নিজ ভূমিতে চাষাবাদও প্রায় অসম্ভব। ফিলিস্তিনিদের ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক ঘাটতি, পানীয় জলের প্রচণ্ড অভাব। অন্যদিকে ইসরাইল সব সীমানা নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের খেয়ালখুশিমতো ফিলিস্তিনিদের দ্রব্যসামগ্রী ও পানি সরবরাহ করে। গাজায় নিজস্ব উদ্যোগে যেসব ‘কমিউনিটি সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ইসরাইল তা ভেঙে দিচ্ছে বুলডোজার, ট্যাংক ও বিমান হামলার মাধ্যমে। ফিলিস্তিনিদের বৈদ্যুতিক লাইন বা বিদ্যুৎ সুবিধা সামান্য, যা ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করত, তা এবার সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। যেসব জেনারেটরের সাহায্যে হাসপাতাল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো, তা এখন সম্পূর্ণ বন্ধ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। ইসরাইল ইচ্ছামাফিক যে কোনো ফিলিস্তিনিকে আটক করে, তাদের নিজেদের গড়া আইন দিয়ে বিচার করে। ইসরাইলের জেলে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ২০০০ থেকে ২৫০০। এতে করে ফিলিস্তিনিরা বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেলেও আবার বন্দি হলে কারও কাছে নালিশ জানানোর স্থান নেই। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনিরা কী করবে? গাজায় কাতার ও অন্যান্য দেশের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত নার্সারি, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষকরাও অনেকে হত্যার শিকার হয়েছেন।
৭ অক্টোবর-পরবর্তী ইসরাইলের নির্বিচার স্থল, নৌ ও আকাশপথে বোমাবর্ষণে গাজা এখন মৃত্যুপুরী। ইসরাইল গাজার হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ ও শরণার্থী শিবিরগুলোয় বোমা বর্ষণ করে নারী-শিশু হত্যাসহ সব ধ্বংস করলেও বিশ্ব বিবেক স্তব্ধ।
গোয়েন্দাদের ধারণা : ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তি সরঞ্জামে সুসজ্জিত। ভূপৃষ্ঠ, মাটির নিচে, অথবা আকাশে যে কোনো সামরিক প্রস্তুতি মোসাদ ধরতে পারে এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। তাহলে গাজায় হামাস দেড় লাখের মতো রকেট আর অগণিত ড্রোন জমা করল কীভাবে? ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা কেন ধরতে পারল না গাজার এতসব টানেল, আগ্নেয়াস্ত্র? এটি এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন! তবে ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ের পণ্ডিত লে. জেনারেল রাজ শুকলার মতে, ইসরাইল জানত নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি গাজায় আনার জন্য তাদের কিছু টানেল রয়েছে। এর মধ্যে ইরানের দান করা কিছু মিলিটারি সরঞ্জাম লেবানন হয়ে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিলি করার বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা ইসরাইলের হাতে ধরা পড়ে। তাই ইসরাইল দ্রুত তাদের গোয়েন্দা নজরদারি পশ্চিম তীরের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে, যাতে বড় ধরনের কোনো হামলা করার পরিকল্পনা পশ্চিম তীরের মানুষ করতে না পারে। দেখার বিষয় হলো, লেবানন হয়ে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের মাঝে অস্ত্র চোরাকারবারি বারবার ধরা পড়ায় ইসরাইল ও আমেরিকার ‘সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানগুলো’ মোটামুটি ধরে নেয় ইরান ও সিরিয়া তাদের মিত্র হিজবুল্লাহর লেবানন হয়ে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত করতে চাইছে। অন্যদিকে গোপনে গাজায় টানেল বিস্তৃতকরণ, প্যারাগ্লাইডিং প্রশিক্ষণ, মোটরসাইকেলসহ সহজ যানবাহনে দ্রুত হামলা চালিয়ে এবং ইহুদিদের বন্দি করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আসার প্রশিক্ষণ সন্তর্পণে চলছিল। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, আমেরিকার সিআইএ তখন পশ্চিম তীরে ব্যাপক মনোনিবেশ করে এবং তারা নিজেরাও দু-একটি হালকা অস্ত্র, তৃতীয় পক্ষ দিয়ে ফিলিস্তিনে চোরাকারবারিতে সাহায্য করে। এতে করে কত হাতিয়ার ও কী ধরনের অস্ত্র পশ্চিম তীরের কোথায় ঢুকছে, তার হিসাব গোয়েন্দা সংস্থা জানে বলে ধরে নেয়।
ভারতের আরেকজন সাবেক গোয়েন্দা অপারেটর কর্নেল বকশি এ বক্তব্য সমর্থন করে উদাহরণ টেনে বলেছেন, মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে যে হামলা হয়, তাতে উগ্রবাদীদের হাতিয়ারের কিছু অংশ তাদের জানামতে প্রদান করা হয়েছিল। এতে উগ্রবাদীদের নাম, সংখ্যা ও গতিবিধি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ভালোভাবে জানত। শুধু কোথায়, কখন ঘটবে তা তাদের জানা ছিল না। গোয়েন্দারা জোর দিয়ে বলেন, তাদের এসব কর্মকাণ্ড উগ্রবাদীদের (তাদের কথায়) নির্মূল করার জুতসই কৌশল বলে তারা বিশ্বাস করেন।
হামাসের হামলা ও চলমান যুদ্ধ কী উন্মোচন করেছে : ইসরাইল পৃথিবীর যে কোনো স্থানে, যে কোনো সময় হামলা চালিয়ে তার টার্গেট নিষ্ক্রিয় করে বীরদর্পে ফেরত আসতে পারে-এ ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। ইসরাইলের গোয়েন্দা পৃথিবী বিখ্যাত, মোসাদ ইসরাইলের প্রতি ইঞ্চি ভূমির ওপর নজরদারি করে-এ ধারণার অবসান হয়েছে। ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনী অজেয়, তাদের কেউ হত্যা বা বন্দি করতে অক্ষম-এ ধারণারও অবসান হয়েছে। ইসরাইলি সমর-সরঞ্জাম-মারকাভা ট্যাংক, ড্রোন, আয়রন ডোম অপ্রতিরোধ্য এবং কেউ তা নিষ্ক্রিয় করতে পারে না-এ ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইসরাইলের যুদ্ধ ব্যয় অপরিসীম, যুক্তরাষ্ট্র পাশে না থাকলে ইসরাইলের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে-এটা দিনের আলোর মতো সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।
কোনো দেশ, জাতি বা গোষ্ঠী যদি জীবন দিয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয় এবং যে কোনো ক্ষতি স্বীকার করেও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকে, তাহলে বিজয় নিশ্চিত। ফিলিস্তিনের জনগণ, বিশেষত গাজায় হামাস তা প্রমাণ করে দিয়েছে। হামাস ও হিজবুল্লাহ টানেল যুদ্ধের মাধ্যমে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। এ দুটি গ্রুপ এত অস্ত্রসম্ভার কীভাবে কোথা থেকে কতদিনে জোগাড় করে মজুত করল, তা বিস্ময়ের ব্যাপার। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব অনেকদিন থেকে বলে আসছে, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন পৃথক দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করে সঠিক সীমানা নিশ্চিত করা আর তিনটি ধর্মের তীর্থস্থান জেরুজালেমকে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। যুদ্ধের মধ্যেও এ ধারণাটিই এখন সবার মুখে মুখে।
লেখকঃ ব্রি. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.) : তুরস্কে বাংলাদেশের সাবেক মিলিটারি অ্যাটাশে