শ্রমের গল্পে আমার নামটা প্রায়ই বাদ পড়ে—শুধু একটি মাত্র কারণ আমি নারী…
সুবর্ণা হামিদ
::
আজ থেকে ২০ বছর আগে যখন আমি সাংবাদিকতা শুরু করি তখন থেকেই যেন এক অদৃশ্য দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে শিখেছি টিকে থাকতে। তুমি মেয়ে, এত দূরে যাবে না, রাতে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবে না,এই রিপোর্টটা তুমি পারবে না, ঝুঁকি নিও না কেউ কেউ আবার বলতো তুমি মেয়ে ঘরে বসে রান্নাবান্না করা তোমার কাজ—এই কথাগুলো আমার নিত্যসঙ্গী ছিল।
অথচ আমি শুধু চাইতাম সত্যটা তুলে ধরতে, অন্য সবার মতোই দায়িত্ব পালন করতে। কিন্তু অনেক প্রতিবেদন দিনের পর দিন ডেস্কেই পড়ে ছিল, শুধু এই কারণে যে আমি একজন নারী। আর অনেক ভালো নিউজ আমি যেটা করতাম সেটা ছাপা হতো পেছনের পৃষ্ঠায় বা সাইডে ছোট করে। আবার একই নিউজ যদি পুরুষরা করতো তাহলে সেটা হতো লিড নিউজ। আমার সাহসকে বলা হতো জেদ। পেশাগত নিষ্ঠাকে উগ্রতা মনে করা হতো । পুরুষ সহকর্মীদের কিছুটা এগিয়ে রাখতে অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে আড়ালে রাখা হয়েছে। আমার সাফল্য অনেকের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়েছে— সিলেটে এখন অনেক নারীরা এগিয়ে এসেছেন এই পেশায়, সহজভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। অথচ ২০ বছর আগে সিলেটে মেয়েদের সাংবাদিকতার করা ছিলো খুই কঠিন
আমরা দু-তিন জনের অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আজ এই রাস্তা সহজ হয়েছে।
আমার সাংবাদিকতা যেন হয়ে উঠেছিল অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ। অফিসের চেয়ারের সামনে বসেও, মাঠে নেমেও লড়তে হয়েছে—পেশার সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, এবং সবচেয়ে বেশি লড়তে হয়েছে নিজের পরিচয়ের সঙ্গে। তবুও থামিনি। কারণ, সত্য বলে ফেলা আমার দায়িত্ব।
এখন অনেক সহকর্মী বড় ভাইয়েরা খুব সহজে সুন্দর করে কথা বলেন কিন্তু তখন এই ভাইয়েরাও আমাকে হিংসা করতেন কারণ আমি নারী।
আজ মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। অথচ এমন দিনেও আমাদের মতো সংবাদকর্মীদের, বিশেষ করে নারী সাংবাদিকদের শ্রমকে কেউ গোনায় ধরে না। আমরা কেবল খবর সংগ্রহ করি না—আমরা প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে ইতিহাসের একেকটি অধ্যায় রচনা করি।
বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকদের পদচারণা বাড়ছে, কিন্তু লড়াইও বাড়ছে অন্য এক মাত্রায়। অনেকেই পরিবার, সমাজ, এমনকি নিজের অফিস থেকেও পর্যাপ্ত সহায়তা পান না। নিরাপত্তাহীনতা, কটাক্ষ, এবং পেশাগত বৈষম্যের মধ্যে দিয়েই তাঁরা এগিয়ে যান—সত্য তুলে ধরার অদম্য ইচ্ছায়।
আমি বিশ্বাস করি, এই লড়াই একদিন সমতা ও সম্মানের পথে পৌঁছে দেবে আমাদের।
আজকের এই দিনে, আমি কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদের—যাঁরা মাইক্রোফোন, ক্যামেরা হাতে মাঠে নামেন, পেছনে থেকে শব্দ খুঁজে ফেরেন, বা কিবোর্ডে আঙুল চালিয়ে সত্যকে লিখে রাখেন।
আমরা সাংবাদিকরা শুধু শ্রম দিই না—আমরা বদলেও দিই।