আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া:
মালয়েশিয়ার বুকিত তুনকুর অভিজাত প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আন্তর্জাতিক ইসলামী চিন্তাধারা ও সভ্যতা ইনস্টিটিউট (আইএসটিএসি-আইআইইউএম) ।
৫ মে, পরিণত হয়েছিল এক ব্যতিক্রমী মিলনমেলায়—যেখানে ইতিহাস, সাহিত্য এবং আধ্যাত্মিকতা এক মহিমান্বিত আবহে একত্র হয়েছিল। আয়োজিত হয়েছিল এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান—“জেজাক হারামাইন কি ইস্তানবুল: ফেব্রুয়ারি ১৯১০ – নভেম্বর ১৯১০”। এর লেখক, বিশিষ্ট মালয় ঐতিহাসিক ও গবেষক হাবিব শেইখ বিন মোহাম্মদ বিন হুসেইন আল-হাবশী, বইটির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন উসমানীয় যুগের ইসলামিক চিন্তাধারার ইতিহাস ও আত্মিক ভ্রমণের অনুপম বিবরণ।
এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে যখন মালয়েশিয়ার জ্ঞানীজন, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা সমবেত, তখন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন একজন বাংলাদেশি অতিথি—গিয়াস উদ্দিন আহাম্মেদ, মালয়েশিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক এবং এক্সপাট সার্ভিসেস কুয়ালালামপুর-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাঁর উপস্থিতি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং তিনি হয়ে উঠেন বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যকার এক আন্তঃসাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রতীক।
উন্মোচিত গ্রন্থটি শুধু একটি ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়—বরং এটি শতবর্ষ আগের হজ ও ইস্তানবুল সফরের মাধ্যমে ইসলামী ঐতিহ্য, উসমানীয় রাজনীতি এবং আত্মিক চিন্তার এক দুর্লভ দলিল। লেখক বইটিতে যেভাবে হারামাইন শরীফ থেকে ইস্তানবুল পর্যন্ত ভ্রমণের আখ্যান বর্ণনা করেছেন, তা আধুনিক মালয় সাহিত্যাকাশে যেন এক আধ্যাত্মিক নক্ষত্রের আবির্ভাব।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও রেক্টর, এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে মালাক্কার রাজ্যপাল তুন সেরি সেতিয়া ড. হাজি মোহ্দ আলি বিন মোহ্দ রুস্তাম। তাঁদের পাশে আরেক আলোচিত নাম—ইয়াং বার বাহাগিয়া দাতোশ্রী (ড.) সায়েদ হুসাইন বিন অব্দ কাদির আল-হাবশী, যাঁর উপস্থিতি যেন বিদেশি অতিথিদের জন্য হয়ে ওঠে এক আভিজাত্য ও ঐতিহ্যের প্রতীক।
এদিন এক বিশেষ মুহূর্তে গিয়াস উদ্দিন আহাম্মেদ রাজ্যপালের হাতে তুলে দেন বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রতীকস্বরূপ রিকশা আকৃতির একটি ক্রেস্ট। এটি কেবল একটি উপহার ছিল না—বরং ছিল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের এক নান্দনিক উপস্থাপন।
তবে গিয়াস উদ্দিন আহাম্মেদের গুরুত্ব শুধুমাত্র এই উপস্থাপনায় নয়—তিনি এই অনুষ্ঠানজুড়ে ছিলেন এক নীরব, অথচ শক্তিশালী উপস্থিতি। কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিয়েও, তিনি হয়ে উঠেন এক মানবিক, সাহিত্যিক এবং প্রবাসী দূত, যিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন, বিশেষত পাসপোর্ট ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে। তাঁর উপস্থিতি যেন প্রমাণ করল—প্রবাস মানে শিকড়চ্যুতি নয়, বরং নতুন শিকড়ের সন্ধান।
এই সাহিত্যিক সন্ধ্যায় বক্তারা যখন আলোচনা করেন উসমানীয় ইতিহাস, হারামাইন শরীফ, মুসলিম বিশ্বে ঐক্য এবং মালয় সাহিত্যচর্চার গুরুত্ব নিয়ে—তখন শব্দ হয়ে ওঠে আলো, উচ্চারণে খুঁজে পাওয়া যায় আত্মপরিচয়ের নতুন সংজ্ঞা। এই আয়োজন আবারও মনে করিয়ে দেয়—সাহিত্য কেবল মনের খাদ্য নয়, বরং একটি জাতির চেতনার ধারক ও বাহক।
গিয়াস উদ্দিন আহাম্মেদের মতো একজন প্রবাসীর সম্মানিত উপস্থিতি এ অনুষ্ঠানকে আরও তাৎপর্যমণ্ডিত করে তোলে। এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত স্বীকৃতিই নয়—বরং হয়ে ওঠে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীদের গৌরবের প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত এক্সপাট সার্ভিসেস কুয়ালালামপুর প্রমাণ করেছে, তারা শুধু প্রবাসীদের কাগজপত্রের সেবা নয়—তাঁদের মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক প্রয়োজনকেও গুরুত্ব দেয়।
৫ মে ২০২৫-এর এই দিনটি ছিল এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটি ছিল এক নতুন সূচনা—যা মালয় ঐতিহাসিকতা, সাহিত্য ও প্রবাসী পরিচয়ের নতুন অধ্যায়ের দ্বার খুলে দেয়। গিয়াস উদ্দিন আহাম্মেদ যেন হয়ে ওঠেন সেই মৌন কণ্ঠস্বর, যিনি ইতিহাস ও সাহিত্যের সঙ্গে মানুষের বন্ধনের তাৎপর্য আবারও তুলে ধরেন।
এই সন্ধ্যা, এই গ্রন্থ, আর এই মানুষ—তিনটি আলোর রেখা, যারা একত্রিত হয়ে রচনা করলেন ইতিহাস, সাহিত্য ও মানবিকতার এক চিরস্মরণীয় অধ্যায়।