আব্দুস সামাদ আজাদ : রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা :
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আব্দুস সামাদ আজাদ একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। ত্রিকালদর্শী এই রাজনীতিবিদ ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে আমৃত্যু রাজনৈতিক পরিক্রমায় রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। দল ও জাতির সংকটকালে তিনি অবতীর্ণ হতেন ত্রাতার ভূমিকায়। দলীয় নেতা হয়েও অনেকটা সর্বদলীয় অভিভাবক হিসেবে তিনি স্বীকৃত ছিলেন রাজনৈতিক অঙ্গনে। একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ যে কূটনীতিবিদ হিসেবেও সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সামাদ আজাদ।
আব্দুস সামাদ আজাদের রাজনীতির হাতেখড়ি ব্রিটিশ আমলে। পাকিস্তান আমলে তিনি একজন সংগ্রামী জননেতা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক হিসেবে রেখেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনে অসামান্য অবদান রাখেন এই ক্ষণজন্মা পুরুষ। মেধা ও বিচক্ষণতা দিয়ে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এক সফল দৃষ্টান্ত আব্দুস সামাদ আজাদ ।
১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ভুরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুস সামাদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি আব্দুস সামাদ নামেই পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি নামের সঙ্গে আজাদ সংযুক্ত করেন।
স্কুল ছাত্র অবস্থাতেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় তিনি সিলেট জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে গণভোটের মাধ্যমে সিলেটের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে আবদুস সামাদ আজাদ সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারবিরোধী রাজনীতির কারণে এম এ শেষ পর্বের পরীক্ষা তাঁকে দিতে দেওয়া হয়নি।
মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন বিলুপ্ত হয়ে গেলে আবদুস সামাদ আজাদ ঢাকায় গণতান্ত্রিক যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি এই সংগঠনের নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
ভাষা সংগ্রামী আব্দুস ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার সিলেট সফরে আসলে তিনি একটি ছাত্র প্রতিনিধিদল নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। তখন ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়। পরে ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তিনি সম্পৃক্ত হন। প্রথমে সিলেট পরে ঢাকায় এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে দশজনি মিছিল করার প্রস্তাবকও তিনি। ঐদিন তিনি গ্রেপ্তার হন ও কারাবরণ করেন।
১৯৫১ সালে নতুন রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে গণতন্ত্রী দলের প্রার্থী হিসেবে যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ন্যাপে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে ন্যাপের সহ-সম্পাদক ও দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন।
আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর আব্দুস সামাদ আজাদের সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু এক সময় গ্রেপ্তার হন। প্রায় চার বছর জেলে থাকার পর ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে তিনি আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং বৃহত্তর সিলেট আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত আপাদমস্তক রাজনীতিক এই জননেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকার গঠন প্রশ্নে দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে তিনি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের ১৩-১৬ মে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোড়ালো ভূমিকা পালন করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর আবদুস সামাদ আজাদ মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রিসভায় তাঁকে পুনরায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির যাত্রা শুরু হয়। পরে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারে কৃষি, সমবায়, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রীরও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর আবদুস সামাদ আজাদকে এক সপ্তাহ গৃহবন্দি করে রাখা হয়। পরে ২২ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে কারাগারে রাখা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ রা নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ডের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত একই সেলে তিনি তাঁদের সঙ্গে বন্দি ছিলেন।কারাগারে থাকা অবস্থায় সামরিক আদালতে আব্দুস সামাদ আজাদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। চার বছর কারাভোগের পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তিলাভের পর সেই সংকটময় সময়ে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে আত্মনিয়োগ করেন। দলে আত্মকলহ,চরম দ্বন্ধ ও ভাঙন দেখা দিলে তিনি দায়িত্বশীল ও দূরদর্শী ভূমিকা পালন করেন।পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতেও তাঁর রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলকে সংগঠিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দলের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে আন্দোলন,সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সামাদ আজাদ কূটনীতিক হিসেবেও ছিলেন সফল। স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশের স্বীকৃতি আদায় ও পরবতীতে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত পানিবণ্টন চুক্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা পালন করেন। একই বছর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদনে তিনি পালন করেন যুগান্তকারী ভূমিকা।
বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে তিনি তৎকালীন সিলেট ২ ( দিরাই – শাল্লা) ও সিলেট ৪ ( ছাতক) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনি বাধায় তিনি অংশ নিতে পারেননি। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে তিনি সিলেট ১, সুনামগঞ্জ ৩ ও সুনামগঞ্জ ৪ আসন থেকে পরাজিত হন। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ বর্জন করে। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে তিনি সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। এসময় সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনে তিনি জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ বর্জন করায় তিনি অংশ নেননি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় নির্বাচনে তিনি পুনরায় একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর সরকার গঠন করলে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিরোধী দলের সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্বপালন করেন।
আব্দুস সামাদ আজাদ দলের সকল ক্রান্তিলগ্নে রেখেছিলেন দায়িত্বশীল ভূমিকা। দেশের প্রগতিশীল ও গনতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ও বিবর্তনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদ গঠন প্রশ্নে খন্দকার মোশতাক যখন চক্রান্ত করেছিলেন তখন সামাদ আজাদই দাঁড়িয়েছিলেন ঐক্যের পক্ষে। পঁচাত্তর সালের ৩ রা নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের আগে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে জেল গেটে বলেছিলেন ” আমরা সবাই তো কারাগারে, সামাদ সাব যদি বাইরে থাকতেন তবে বাঁচার আশা থাকতো।”, ৭৫ এর পর দল পুর্নগঠনে জেলে থেকেও তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন কে দলের আহবায়ক নির্বাচিত করতে তিনি ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে অর্ভ্যথনা কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি পালন করেন দায়িত্বশীল ভূমিকা। তার বিচক্ষণ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে দল আরেক দফা ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পায়। এই সম্মেলনে আব্দুস সামাদ আজাদকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়েছিল। তবুও তিনি ঐক্যের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দলীয় নেতৃত্বে অভিষিক্ত করতে পালন করেন যুগান্তকারী ভূমিকা। শেখ হাসিনা পরবর্তীতে সেই সম্মান সামাদ আজাদকে দিতে কুন্ঠাবোধ করেননি। অনেকবার আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করেছেন সামাদ আজাদকে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর আব্দুস সামাদ আজাদকে রাষ্ট্রপতি করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে তাঁকে অবগতও করেছিলেন কিন্তু দলের একটি অংশের বিরোধীতার কারণে সামাদ আজাদকে আর রাষ্ট্রপতি করা হয়নি।
আব্দুস সামাদ আজাদের পুরো জীবনটাই সংগ্রামমুখর। দলের ভেতর, বাইরে নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তাঁকে এগিয়ে যেতে হয়েছে গভীর আত্মপ্রত্যয়ে। বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর ছিল হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা। কেউ কোনো ব্যাপারে তাঁর কাছে গেলে বাড়িয়ে দিতেন সাহায্যের হাত। নিখাদ দেশপ্রেমিক এই সংগ্রামী জননেতা বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির ছিলেন এক অভিভাবক। বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি ও দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন চুক্তি করে বাংলাদেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে তিনি সচেতন থাকতেন। স্বভাবসুলভ আন্তরিকতা ও প্রবীন জননেতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষের সমর্থন আদায় করে নিতেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়ন ও বিরোধী দলগুলোর জোটবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনায় তিনি ছিলেন ঐক্যের প্রতীক। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তিনিই ছিলেন সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রধান নেতা। আওয়ামী লীগ সভাপতির অনুপস্থিতিতে তিনি বিভিন্ন সময় দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের সকল দুর্যোগে দলকে সঠিকভাবে পরিচালনায় পালন করেছেন অভিভাবকের ভূমিকা। বর্তমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ যখন ছন্নছাড়া, নেতৃত্বহীন তখন তাঁর মতো অভিজ্ঞ নেতার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল এমন ভাবনা দলের নেতাকর্মীদের।
প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে গিয়ে রাজনীতিতে সুসংহত অবস্থান সৃষ্টি। এবং জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করা তখনকার প্রেক্ষাপটে ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জিং। রাজনীতিতে অভিজাত শ্রেণীর বিভিন্ন প্রতিবদ্ধকতা তিনি একাগ্রতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে মোকাবিলা করে হয়ে ওঠেছিলেন গণমানুষের নেতা। জনদরদী প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ।
আব্দুস সামাদ আজাদের তিরোধান বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর শূন্যতার সৃস্টি করে। দল,মত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণী,পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর হৃদতা। একজন সদালাপী,কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে দলের প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সকল পর্যায়ে তাঁর ছিল ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। রাজনীতির ধ্যান জ্ঞান এই জননেতা গভীর রাত পর্যন্ত কর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। বৃদ্ধ বয়সেও অসুস্থ শরীর নিয়ে সাংগঠনিক প্রয়োজন আর সামাজিক অনুষ্ঠানে ছুটে বেড়াতেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল। শুধু নিজ দলের কর্মী নয় ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গেও সদ্ভাব রাখতেন। প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিতেন সাহায্যের হাত। অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এই বর্ষিয়ান নেতা ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মানুষ। ৭৫ এর পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন ” আমি তো বর্ধিত জীবন নিয়েই বেঁচে আছি। ৭৫ এর ৩ রা নভেম্বর হতে পারতো আমার মৃত্যু দিন।” অপর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন ” আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চাই। স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য রাজনীতি করেছিলাম। দেশ অনেক এগিয়েছে। মানুষের মুক্তি এখনো হয়নি। কিন্তু দিন দিন রাজনীতি কঠিন হয়ে যাচ্ছে।” বর্তমান নিঃসীম অন্ধকারে আব্দুস সামাদ আজাদের মতো একজন দূরদর্শী, সমন্বয়বাদী, গ্রহণযোগ্য রাজনীতিবিদের তীব্র অভাব শুধু উপলব্ধি হচ্ছে সর্বমহলে।
সংগঠন অন্তপ্রাণ এই জননেতার কাছে রাজনীতি ছিল ধ্যান জ্ঞান । রাজনীতিকে তিনি বলতেন ” হাক্কুল ইবাদ ” মানে বান্দার হক। ” হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ ” শব্দ দুটি উচ্চারণ করে রাজনীতি যে ইবাদতের অংশ তা তিনি মনেপ্রাণে ধারণ করতেন,কর্মীদের উৎসাহ দিতেন। সময়কে ধারণ করে সফল রাজনীতিবিদ হয়েছিলেন সামাদ আজাদ। নতুন প্রজন্মকে সময় ও বাস্তবতা ধারণ করে তাঁর অহিংস, যুক্তিবাদী ও সকলকে নিয়ে রাজনীতি এই চিন্তা – চেতনাকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই তাঁর প্রতি প্রকৃষ্ট শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব। প্রয়োজনের আয়োজন নয় সামাদ আজাদ কে ধারণ করতে হবে নির্মোহ ভাবে। ইতিহাসের প্রয়োজনেই। রাজনীতির বটবৃক্ষ জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।